Durga Puja 2023: সেন বাড়ির পুজোয় দেবীর ভোগের রান্নায় ব্যবহার করা হয় না তেল, হলুদ ও লবণ!

বহরমপুরে সেন বাড়ির দুর্গাপুজোর ইতিহাস যেন কথা বলে
Durga_Puja_2023_(1)
Durga_Puja_2023_(1)

মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: বর্গি মারাঠি আক্রমণে জর্জরিত হয়ে সেন বংশের কোনও এক বংশধর শ্যামচরণ সেন/গোবিন্দচন্দ্র সেন তাঁদের আদি নিবাস চক ইসলামপুর ত্যাগ করে বহরমপুরে চলে আসেন। পরবর্তীকালে অধুনা বহরমপুর মিউনিসিপ্যালিটির অন্তর্গত তিন নম্বর গিরিজা চক্রবর্তী লেনে প্রতিষ্ঠিত হয় সেন বাড়ির পুজো (Durga Puja 2023)। আনুমানিক ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে (সময়টি অনেক আগেও হতে পারে) সেন বাড়িতে দুর্গাপুজোর সূচনা করেন রাধাকৃষ্ণ সেন। যদিও এক্ষেত্রে কাণ্ডারির ভূমিকা নেন তাঁরই বাল্যবিধবা কন্যা বিন্দুবাসিনী দেবী। তবে বিন্দুবাসিনী দেবী অনেক আগে থেকেই এই বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো করতেন।

পুজোর বৈশিষ্ট্য

পরম্পরা অনুসারে সোজা রথের দিন পুরোহিত ও কারিগর দিয়ে প্রতিমার কাঠামোতে গঙ্গামাটি লেপানোর মাধ্যমে দুর্গাপুজো শুরু হয়। প্রতিমা গড়া হয় বাড়ির ঠাকুর দালানে। ভাদ্র মাসে সেন বাড়িতে প্রতিমা নির্মাণ বন্ধ থাকে। এটা এই বাড়ির রীতি তথা নিয়ম। সেন বাড়ির মূল পুজো (Durga Puja 2023) শুরু হয় ষষ্ঠীতে। এই সময় বাড়ির সধবা বউ কলস প্রদর্শন করেন। এরপর হয় দেবীর বোধন ও অধিবাস। ষষ্ঠীর দিন বাড়ির ঠাকুর দালানে টাঙানো হয় রচনা। সাত রকম ফল, বেলপাতা ও সোলার কদম ফুল দিয়ে তৈরি রচনা সেন বাড়ির পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সেন বাড়ির সন্ধিপুজো বিশেষ বৈশিষ্ট্য বহন করে। ১০৮ পদ্ম, ১০৮ ঘের প্রদীপ এবং ১০৮ বেলপাতা দেবীকে নিবেদন করা হয়। আগে সন্ধির শুরু ও সমাপন হত শূন্যে গুলিবর্ষণের মাধ্যমে। যদিও আজ সেই প্রথা পারিবারিক কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সেন বাড়ির পুজো হয় বৈষ্ণব মতে, তাই পশুবলি নিষিদ্ধ। তবে নবমীতে আখ ও চালকুমড়ো বালি দেওয়া হয়। সেন বাড়ির পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য দশমীর অপরাজিতা পুজো, ঘট বিসর্জন ও দর্পণের বিসর্জনের মাধ্যমে পুজোর সমাপ্তি ঘটে। দশমীর বিকালে স্থানীয় মুটেদের ঘাড়ে চেপে বাড়ির দিকে মুখ করে দেবী বিসর্জনের জন্য যাত্রা করে।

প্রতিমার বৈশিষ্ট্য

সেন বাড়ির একচালার সাবেকি প্রতিমা (Durga Puja 2023)। তবে তথাকথিত খাস বাংলা প্রতিমা নয়, এটাই এ বাড়ির রীতি। সেন বাড়ির মা দুর্গা দ্বিতীয় ডানহস্তের পরিবর্তে শেষ হস্তে মহিষাসুরকে ত্রিশূল দ্বারা বধ করেন। দেবী দুর্গা একই কাঠামোতে সপরিবারে বিরাজমান। সেই ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে যে শাল কাঠের কাঠামোতে পুজো শুরু হয়েছিল, আজও সেই কাঠামোতেই পুজো হয়ে আসছে। যদিও কালের নিয়ম ও সংস্কারের প্রয়োজনে বেশ কয়েকবার কাঠামোটির সংস্কার করা হয়েছে।

ভোগের বৈশিষ্ট্য

সেন বাড়ির ভোগ হয় নিরামিষ। বাড়িতে দেবীকে কখনই রান্না করা অন্য ভোগ দেওয়া হয় না। পরবর্তীতে লুচি, তরকারি, পাঁচ ভাজা, পাঁপড় ও বাড়ির তৈরির নারকেল নাড়ু নিবেদন করা হয়। আর নবমীতে পাকা কলার বড়া, পটল পোড়া দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও প্রতিদিন ভোগের তালিকায় থাকে দই, ছানা, মিছরি, আদা, লেবু ও পান। দেবীর ভোগের রান্নায় কোনও রকম তেল, হলুদ ও লবণ ব্যবহার করা হয় না। তেলের পরিবর্তে গাওয়া ঘি ব্যবহার করা হয়, আর লবণের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় সন্দক লবণ। ষষ্ঠী থেকে নবমী (Durga Puja 2023) প্রতিদিন ১৭ টি করে নৈবেদ্য দেওয়া হলেও সন্ধি পুজোর সময় দেবীকে ১৯ টি নৈবেদ্য নিবেদন করা হয়। যদিও জমিদারি আমলে দেবীকে ১৭ রকমের চালের নৈবেদ্য চূড় করে দেওয়া হত। তবে আজও নৈবেদ্য প্রথমে কোনও ব্রাহ্মণের বাড়ি আগে যায়।

পুজোর মাহাত্ম্য

সেন বাড়ির ঠাকুর অত্যন্ত জাগ্রত। আজ থেকে বহু বছর আগে সপ্তমীর ঘট ভরে ফেরার পথে কোনও ভাবে ভুলক্রমে পুরোহিতের পা স্পর্শ করে। ওই দিনই পুরোহিতের মৃত্যু ঘটে, পুনরায় নতুন পুরোহিত দিয়ে পুজো শুরু হয়। অতীতে দুবার দেবীর কাঠামো ভাগীরথী নদীতে ভেসে গেলেও কোনও অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে দুবার তা ফেরত পাওয়া যায়। কয়েক বছর আগে তীব্র পারিবারিক বিবাদের ফলে পুজো প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ঠাকুরের মহিমায় পুজো (Durga Puja 2023) অতীতের সেই রীতি-নীতি, নিয়ম-নিষ্ঠা ও পরম্পরা বজায় রেখে আজও চলছে।

মহিলাদের ভূমিকা

যেহেতু এই পুজোটি বিন্দুবাসিনী দেবীর ইচ্ছা অনুসারে, তাই পরবর্তীকালে সুচন্দ্র বদনী দেবী তাঁর নিষ্ঠা, ভক্তি, একাগ্রতা ও সাধনার মাধ্যমে এই পুজোকে আগলে রাখেন। মূলত তাঁরই উদ্যোগে এই বাড়িতে কয়েক বছর সন্ধি পুজোর সময় কুমারী পুজো (Durga Puja 2023) অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ সরমা সেন আমৃত্যু পুজোর প্রতি কর্তব্য অবিচল ছিলেন।

এই পুজো কারা করতেন

রাধাকৃষ্ণ সেনের মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র যোগেশচন্দ্র সেন ও পুত্রবধূ সুচন্দ্র বদনী দেবী এই পুজোর (Durga Puja 2023) দায়িত্ব নেন। জমিদার যোগেশচন্দ্র সেনের সময়কালকে সেন বাড়ির পুজোর স্বর্ণযুগ বলা হয়। পুজো উপলক্ষ্যে সেন বাড়িতে বসত চাঁদের হাট, আসতেন কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, কমলারঞ্জন রায়, স্থানীয় জমিদার হরিবাবু সহ অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তি। এই পুজোতে অনেক স্থানীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আগমন ঘটত। সেন বাড়িতে নবমীতে বসত যাত্রার আসর। কবিওয়ালা শোনাতেন কবিগান। নবমীতে স্থানীয় মানুষের নিমন্ত্রণ থাকত। পেশায় আইনজীবী যোগেশবাবুর আমলে সেন বাড়ির পুজো উৎকর্ষতার শীর্ষে পৌঁছায়।
পরবর্তীকালে যোগেশচন্দ্র সেন ও সুচন্দ্র বদনী দেবীর মৃত্যুর পর তাঁর বংশধররা এই পুজো চালাতে থাকেন। এ ব্যাপারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, যোগেশচন্দ্র সেন ও সুচন্দ্র বদনী দেবীর ষষ্ঠ পুত্র স্বর্গীয় প্রশান্তকুমার সেনের নাম। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সিভিল সার্ভিস অফিসার প্রশান্তবাবু পুজো পরিচালনা, সংস্কার ও অন্যান্য বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী হয়ে ওঠেনে। মূলত তাঁরই উদ্যোগে দশমীর সন্ধ্যায় দেবীর নৌকা ভাগীরথী ভ্রমণে সম্ভব হয়ে ওঠে।
এখনও সেন বাড়িতে রীতিনীতি মেনেই সেই পুজো হয়ে আসছে এবং দূর দূরান্ত থেকে আসেন আত্মীয়-স্বজনরা।

 

দেশের খবরদশের খবরসব খবরসবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের FacebookTwitter এবং Google News পেজ।

Share:

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn

You may also like

+ There are no comments

Add yours

Recent Articles