মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: মহাকাব্য রামায়ণের রচয়িতা তিনি। মর্যাদা পুরুষোত্তম রামচন্দ্রের বীরত্ব গাথা, তাঁর উন্নত নৈতিক চরিত্র কে সংস্কৃত শব্দের দ্বারা ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। এরপর বহু ভাষায়, বহু অঞ্চলে তাঁর রচনাকে প্রামাণ্য ধরে রামায়ণের অনুবাদ চলেছে। আজ মহর্ষি বাল্মীকির জন্মতিথি বা জন্মজয়ন্তী (Valmiki Jayanti 2022)। শারদীয়া দুর্গাপূজার পরের পূর্ণিমায় সারাদেশ ব্যাপী মহাসমারোহে পালিত হয় বাল্মীকি জয়ন্তী। কোথাও মহর্ষি বাল্মীকির প্রতিকৃতি কে পুজো করা হয় কোথাও আবার সুসজ্জিত শোভাযাত্রার মাধ্যমে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয়।
কৃত্তিবাসী রামায়ণের সূচনায় মহর্ষি বাল্মীকির প্রথম জীবনের কাহিনী উল্লেখ রয়েছে। যা কমবেশি আমরা সকলেই শুনেছি। প্রথম জীবনে মহর্ষি বাল্মীকি ছিলেন একজন দস্যু। তাঁর পিতার নাম ছিল প্রচেতা। প্রথম জীবনে বাল্মীকির নাম ছিল রত্নাকর। তিনি দস্যুবৃত্তির দ্বারা পরিবারের ভরণ পোষণ করতেন। একদিন দেবর্ষি নারদ রাজপথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে বাল্মীকি নারদের সন্নিকটে উপস্থিত হলে, দেবর্ষি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, দস্যুবৃত্তি করে তিনি যে পাপ করছেন তাঁর এই পাপের ভাগী তাঁর পরিবার হবে কি? নারদের কথায় তিনি তার পরিবারের সদস্যদের এই প্রশ্ন করলে সকলেই জানান যে তাঁর পাপের ভাগী তাঁরা হতে চান না। এরপর দস্যুজীবনের পরম সত্য উপলব্ধি করে তিনি দেবর্ষি নারদের নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করেন। নারদ তাঁকে রাম নাম জপ করতে শেখান এবং বলেন এই নামের দ্বারাই তাঁর পূর্বের পাপ ক্ষয় হবে।
কথিত আছে, দস্যু সাধনায় বসেন এবং ব্রহ্মের বরে কবিত্বশক্তি পান। সাধনাকালে তাঁর দেহ বল্মীকের (সংস্কৃত তে যাকে পিঁপড়ের ঢিবি বলে) স্তুপে ঢেকে গিয়েছিল বলে তাঁর নামকরণ করা হয় বাল্মীকি (Valmiki Jayanti 2022)। এরপর অনেকেই তাঁর কাছ থেকে দীক্ষা নেন ও শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁকে সংস্কৃত ভাষার আদি কবিও বলা হয়। প্রথম সংস্কৃত শ্লোকের রচয়িতা হিসেবে তাঁকেই মানা হয়। এই প্রসঙ্গে একটি কাহিনী রয়েছে। মহর্ষি বাল্মীকি একবার তাঁর শিষ্য ভরদ্বাজকে সাথে নিয়ে তমসা-তীর্থে স্নান করতে যাত্রা পথে প্রকৃতির অপরূপ নৈসর্গিক শোভা দেখছিলেন। এমন সময় এক ব্যাধ বাল্মীকির সামনে এক ক্রৌঞ্চযুগলের মধ্যে পুরুষ ক্রৌঞ্চকে তীরবিদ্ধ করে। স্ত্রী ক্রৌঞ্চটি করুণ সুরে বিলাপ করতে থাকে। এই দৃশ্য দেখে ক্রদ্ধ বাল্মীকির মুখ থেকে অভিশাপ বাণীর আকারে উচ্চারিত হয় সৃষ্টির প্রথম শ্লোক :
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।
- নিষাদ, তুই চিরকাল প্রতিষ্ঠা লাভ করবি না, কারণ তুই কামমোহিত ক্রৌঞ্চমিথুনের একটিকে বধ করেছিস। কথিত আছে এরপর বাল্মিকী ব্রহ্মাকে ব্যাধ এর কথা বলে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। ব্রহ্মা তখন বলেছিলেন, “শোকের সময় এটি তোমার মুখ হতে নিঃসৃত হয়েছে। অতএব, এটি শ্লোক নামে অভিহিত হোক। তুমি এরূপ শ্লোকে রামচরিত্রের আখ্যান রামায়ণ গ্রন্থ রচনা কর।" সেই অনুসারে মুনিবর বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করেন। শোক থেকে উৎপন্ন এই শ্লোক সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম শ্লোক হিসেবে গণ্য হয়। পরবর্তীকালে এই শ্লোকের ছন্দেই বাল্মীকি সমগ্র রামায়ণ রচনা করেন। বাল্মীকি রচিত মূল রামায়ণে ২৪,০০০ শ্লোক ছিল। এই রামায়ণ ছয়টি (মতান্তরে সাতটি) কাণ্ড বা খণ্ডে বিভক্ত ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ থেকে ১০০ অব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে এই মহাকাব্য রচিত হয় বলেই ঐতিহাসিকদের ধারণা। মহর্ষি বাল্মীকি রামায়ণ ব্যতীত যোগবশিষ্ঠ নামক অপর এক হিন্দু ধর্মগ্রন্থের রচয়িতা বলেও মনে করা হয়। অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত কাব্যে এই কবির ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাল্মীকি কর্তৃক রামায়ণ রচনার নেপথ্য-আখ্যান অবলম্বনে বাল্মীকি-প্রতিভা গীতিনাট্যটি রচনা করেছিলেন।
+ There are no comments
Add yours