মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: অপত্য স্নেহের মর্মান্তিক পরিণতি! ঘটনার গভীরে ঢুকলে মনে হবে, সত্যি, এও সম্ভব? গত বৃহস্পতিবার উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে এক সদ্যোজাত শিশু চুরি (Child Abduction) হয়ে যায়। শনিবার রাতে উত্তর দিনাজপুর জেলার চোপড়া থানার বিহার লাগোয়া বলরামপুর গ্রাম থেকে সেই শিশুকে উদ্ধার করে আনে শিলিগুড়ি মেট্রোপলিটন পুলিশ। শিশুচুরিতে মূল অভিযুক্ত সীতা দাস ও তার মেয়ে অঞ্জু দাসকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের ধরার পরই বেরিয়ে আসে সেই ঘটনা, যা একাধারে মর্মন্তুদও।
কেন এবং কীভাবে এই চুরি?
পুলিশ জানতে পেরেছে, অঞ্জু দাসের প্রায় ১০ বছর বিয়ে হলেও কোনও সন্তান হয়নি। ফলে সংসার ভেঙে গেছে। সন্তান হলেই সংসার জোড়া লাগবে, এই ভাবনায় সীতাদেবী মেয়ের কোলে একটি সন্তান দেওয়ার জন্য অনেকদিন ধরে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। ডাক্তার, ওঝা, মন্দির, মাজার কোনও কিছুই বাকি রাখেননি। একে একে সব চেষ্টা ব্যর্থ হতেই তিনি ঠিক করেন, এবার কোনও হাসপাতাল থেকে শিশু তুলে (Child Abduction) আনা ছাড়া কোনও পথ নেই। সেইমতো উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসে তিনি কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে সবকিছু খতিয়ে দেখেন। কোথায় নিরাপত্তার গাফিলতি রয়েছে, কোন সময় কিভাবে শিশু তুলে নিয়ে পালিয়ে গেলে ধরা পড়তে হবে না, সবকিছু যাচাই করে তিনি গত বৃহস্পতিবার অপারেশনে নামেন। গ্রামে বলে এসেছিলেন, ইঞ্জেকশন (পড়ুন আইভিএফ) দিয়ে তার মেয়ের বাচ্চা হবে।
বৃহস্পতিবার সকালে তিনি মেয়েকে নিয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছে যান। বেলা বারোটা নাগাদ প্রসূতি ওয়ার্ডে ঢুকে পড়েন। শিলিগুড়ি মহকুমার খড়িবাড়ি ব্লকের বাতাসির গৃহবধূ রঞ্জিতা সিংহের বেডের কাছে গিয়ে গল্প জমান। সেই সময় রঞ্জিতাকে তার মা খাইয়ে দিচ্ছিলেন। হঠাৎই কেঁদে ওঠে রঞ্জিতার সদ্যোজাত পুত্রসন্তান। এটাই সুযোগ। সীতাদেবী রঞ্জিতাকে বলেন, বাচ্চাকে দাও, বাইরে থেকে ঘুরিয়ে শান্ত করে আনি। এই বলেই শিশু নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যান সীতাদেবী। তারপর তার কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি।
কীভাবে উদ্ধার হল শিশু?
উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডের সিসিটিভিগুলি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে না। ফলে ফুটেজ দেখে অপরাধীকে শনাক্ত করার সুযোগ ছিল না। অন্ধকারে হাতড়ে ২৪ ঘণ্টা কেটে যায়। হঠাৎই শুক্রবার হাসপাতালের সিক নিওন্যাটাল কেয়ার ইউনিটের (এসএনসিইউ) এক নার্স তাঁদের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ ঘাঁটতে গিয়ে দেখেন, এক মহিলা শিশু কোলে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে (Child Abduction)। তার সামনে সামনে নাইটি পরা কমবয়সী এক মহিলা যাচ্ছে। সীতাদেবী তাঁর মেয়েকে সদ্যোজাত সন্তানের মা সাজানোর জন্য নাইটি পরিয়ে হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। ব্যাগটি ছোট ও হালকা হওয়ায় নার্সের সন্দেহ হয়। সন্তান জন্মের পর হাসপাতাল থেকে যাওয়ার সময় সাধারণত এত ছোট এবং হালকা ব্যাগ থাকে না। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি তিনি পুলিশকে জানান।
সিসিটিভি ফুটেজ দেখে শুরু তদন্ত
শুক্রবার রাত তিনটে নাগাদ মেডিক্যাল কলেজ ফাঁড়ির ওসি সুদীপ দত্ত এবং মাটিগাড়া থানার আইসি সমীর দেওসা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে সেই অংশটি (Child Abduction) রেকর্ড করেন। শিলিগুড়ি পুলিশের এডিসিপি শুভেন্দ্র কুমার রবিবার বলেন, দুই মহিলাকে খুঁজতে এরপর শহরের বিভিন্ন জায়গার সিসিটিভির ফুটেজ দেখে পুলিশ নিশ্চিত হয়, একাধিকবার গাড়ি পালটে ওই দুই মহিলা চোপড়ার বাসে উঠেছে। সেইমতো শিলিগুড়ি থেকে পুলিসের একটি তদন্তকারী দল চোপড়া পৌঁছে যায়।
আশার আলো জ্বাললেন আশাকর্মীরা
কিন্তু চোপড়ার কোথায় রয়েছে সেই শিশু, কীভাবে তা জানা যাবে? চোপড়া থানায় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর সেখানকার আশাকর্মীদের সাহায্য নেওয়া হয়। কেননা তাঁরাই প্রতিটি এলাকার খোঁজ রাখেন, কোন বাড়িতে বাচ্চা হয়েছে। সেইমতো আশাকর্মীদের কাছ থেকে খবর আসে, বলরামপুর গ্রামের একটি বাড়িতে দু'দিন হল সদ্যোজাত শিশু এসেছে। সেই বাড়িতে দুই মহিলা থাকেন। শনিবার দুপুরের আগেই পুলিশ পৌঁছে যায় চোপড়ার বলরামপুর গ্রামে। শিশুসহ ধরা পড়েন অঞ্জু দাস। তাঁর মা বাড়িতে ছিলেন না। অঞ্জু দাস ও তাঁর দুই ভাই সহ চুরি (Child Abduction) যাওয়া শিশু নিয়ে শিলিগুড়ির উদ্দেশে রওনা দেয় পুলিশ। শনিবার রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাঁরা পৌঁছন। স্বস্তি ফেরে সব মহলে। মূল অভিযুক্ত সীতাদেবীকে শনিবার শেষ রাতে ওই গ্রাম থেকে গ্রেফতার করে রবিবার সকালে শিলিগুড়িতে আনা হয়।
সন্তান ফিরে পেয়ে খুশি রঞ্জিতা ও তাঁর পরিবার
শনিবার রাতে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এসএনসিইউ-তে নিজের পূত্রসন্তানকে কোলে তুলে নিয়ে আনন্দের কান্নায় ভাসেন রঞ্জিতা ও তাঁর স্বামী নিত্যানন্দ সিংহ। কিন্তু এই শিশুই যে রঞ্জিতার চুরি (Child Abduction) যাওয়া সেই শিশু, তার প্রমাণ কী? উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার ডাঃ সঞ্জয় মল্লিক এবং পুলিশ বলেন, যে কাপড় দিয়ে শিশুকে জড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই কাপড় সহ আমরা শিশুকে উদ্ধার করে এনেছি। যাদের ধরা হয়েছে, তারাও স্বীকার করেছে এই শিশুকে তারা এখান থেকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। উপযুক্ত প্রমাণ থাকার কারণেই ডিএনএ পরীক্ষা করার কোনও প্রয়োজন নেই।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook, Twitter এবং Google News পেজ।
+ There are no comments
Add yours