মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: প্রাচীন ভারতের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সারদা পীঠ (Sharada Peeth)। ঐতিহাসিকদের মতে, দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান চর্চার উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র ছিল। এখানেই আদি শঙ্করাচার্য, কলহন শিক্ষাদান করতেন বলে জানা যায়। সারদা পীঠেই রচিত হয়েছিল অসংখ্য সংস্কৃত পান্ডুলিপি। সংস্কৃত শিক্ষার পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তান অধ্যুষিত কাশ্মীরের অবস্থিত। সারদা পীঠের বর্তমান অবস্থান পাক অধিকৃত কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফরাবাদ থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে এবং জম্মু কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে। সারদা পীঠে বিভিন্ন বৈদিক ধর্মের কাজ, ধর্মগ্রন্থ রচনা, অনুবাদ, ভাষ্যের কাজ চলত বলে জানা যায়। এরপাশাপাশি একাধিক বিষয়ে ছাত্ররা পাঠ নিতেন পণ্ডিতদের কাছে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে সারদা পীঠ ছিল তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক এবং নালন্দার চেয়েও বহু পুরনো।
সারদা নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিদ্যার দেবী অর্থাৎ দেবী সরস্বতী নাম
সারদা (Sharada Peeth) নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিদ্যার দেবী অর্থাৎ দেবী সরস্বতী নাম। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন নামকরণ থেকেই বোঝা যায় জ্ঞান ও বিদ্যা চর্চার এক উৎকর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। প্রসঙ্গত, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, দেবী সরস্বতীর আবাস ছিল কাশ্মীরে এবং সেই অনুযায়ী এই শ্লোক আজ ও উচ্চারিত হয়-
“नमस्ते शारदे देवी काश्मीरपुरवासिनि, त्वामहं प्रार्थये नित्यं विद्यादानं च देहि मे”
২৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থাপন করা হয়েছিল
ঐতিহাসিকদের গবেষণা থেকে জানা যায়, ২৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থাপন করা হয়েছিল। আবার অনেক গবেষক মনে করেন, কুষাণদের রাজত্বকালে প্রথম শতাব্দীর দিকে এটি নির্মিত হয়েছিল। সারদা পীঠের (Sharada Peeth) সঙ্গে আদিগুরু শঙ্করাচার্যের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে। মনে করা হয় আদিগুরু শঙ্করাচার্য সারদা পীঠের দায়িত্ব নেওয়ার আগে সেখানে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরাই শিক্ষাদান করতেন। দেশভাগের আগে পর্যন্ত সারদা পীঠ ছিল ভারতের তিনটি প্রধান মন্দিরের অন্যতম। অন্য দুটি হল মার্তন্ড সূর্য মন্দির অমরনাথ মন্দির।
সারদা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পাঁচ হাজারেরও বেশি পণ্ডিত ও ছাত্র
ঐতিহাসিকদের গবেষণা থেকে জানা যায়, সারদা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পাঁচ হাজারেরও বেশি পণ্ডিত ও ছাত্র। সেখানে একটি লাইব্রেরিও ছিল। এই গ্রন্থাগার নালন্দার থেকে কোনও অংশে কম ছিল না। এখানে বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা যেমন দেওয়া হতো, তেমনই ইতিহাস, ভূগোল, স্ট্রাকচারাল সায়েন্স, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন ইত্যাদিও পড়ানো হতো। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, প্রাচীন ভারতের সবথেকে বৃহত্তম গ্রন্থাগার সারদা বিশ্ববিদ্যালয়তেই ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি নিজস্ব লিপির কথাও জানা যায়, একটি হল সারদা লিপি এবং অপরটি হল নাগরী লিপি।
সারদা পীঠে হিন্দু বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি জৈন সমাজের পণ্ডিতরাও যুক্ত ছিলেন
সারদা পীঠে (Sharada Peeth) হিন্দু বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি জৈন সমাজের পণ্ডিতরাও যুক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। রামানুচার্য সারদাপীঠ দর্শন করেছিলেন বলে জানা যায়। চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং সারদা পীঠে আসেন। এই পীঠকে জ্ঞান ও শিক্ষার এক উৎকর্ষ এবং সমৃদ্ধ কেন্দ্র হিসেবে তিনি নিজের বিবরণীতে লেখেন। দেশভাগের পরবর্তীকাল থেকেই পাকিস্তান মদদপুষ্ট সন্ত্রাসবাদীদের হানা চলতে থাকে জম্মু-কাশ্মীরে। যার ফলে এই মন্দিরটি পরিত্যক্ত হয়ে ওঠে। ২০০৫ সালে কাশ্মীরে ভূমিকম্পের ফলে মন্দিরটি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদিও পাকিস্তান সরকার এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ এবং পুনরুদ্ধারের জন্য কোনও রকমের ব্যবস্থা নেয়নি।
আদি শঙ্করাচার্য পাঠদান করতেন
বহু উল্লেখযোগ্য পণ্ডিতদের নাম জড়িয়ে রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন-
কলহন: কলহন ছিলেন প্রাচীন ভারতবর্ষের একজন ঐতিহাসিক। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ রাজতরঙ্গিনী সংস্কৃত ভাষায় লেখা। এটি কাশ্মীরের ওপর লেখা একটি ইতিহাস।
আদি শঙ্করাচার্য: আদি শঙ্করাচার্যের নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণের ইতিহাস। আদি শঙ্করাচার্যও যুক্ত ছিলেন সারদা পীঠের সঙ্গে।
কুমারজীব: সারদা পীঠের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বৌদ্ধ পণ্ডিত কুমারজীবের নাম যিনি একজন অনুবাদক ছিলেন।
হিন্দুদের বিশ্বাস, সতীর ডান হাত এখানে পড়েছিল
প্রসঙ্গত, ৫১ শক্তি পীঠের মধ্যে অন্যতম হল সারদা পীঠ। হিন্দুদের বিশ্বাস, সতীর ডান হাত এখানে পড়েছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, কলহন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ রাজতরঙ্গিনীতে লেখেন, অষ্টম শতাব্দীতে গৌড় রাজা ললিতাদিত্যের শিষ্যরা সারদা মন্দিরের দর্শনের জন্য বাংলা থেকে কাশ্মীরে এসেছিলেন। আকবরের সভাকবি আবুল ফজলের লেখাতেও উল্লেখ মেলে সারদা পীঠের।
সাম্প্রতিক সময়ে ফের একবার সারদা পীঠ খবরের শিরোনামে এসেছে
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে ফের একবার সারদা পীঠ খবরের শিরোনামে এসেছে। গত বছরেই ২২ মার্চ ২০২৩ সালে কুপওয়ারাতে সারদা মন্দিরের ভার্চুয়াল উদ্বোধন করেন অমিত শাহ এবং সে সময় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সারদা পীঠ যা বর্তমানে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে অবস্থিত, এটি ভারত থেকে আসা হিন্দু তীর্থযাত্রীদের জন্য খুলে দেওয়া উচিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সারদা পীঠের মতোই শিখ তীর্থযাত্রী যাত্রীদের জন্য কর্তারপুরে একটি করিডোর ইতিমধ্যে খোলা হয়েছে। সেরকমই সারদা পীঠে (Sharada Peeth) হিন্দু তীর্থযাত্রীদের জন্য করিডর খোলা হবে নাকি তা ভবিষ্যতেই বোঝা যাবে।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।
+ There are no comments
Add yours