তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় পাল: দিনকয়েক আগেই এক বাঙালি নারীর 'সাহসিকতা' দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন বঙ্গ সমাজ। এসএসসি দুর্নীতি মামলায় পার্থ চট্টোপাধ্যায় তখন ইডি হেফাজতে। নিয়মমাফিক জোকা ইএসআই হাসপাতালে তাঁর শারীরিক পরীক্ষা হচ্ছে। রুটিন মেনে পরীক্ষা করানোর পরে পার্থবাবু গাড়িতে উঠেছেন, তাঁকে লক্ষ্য করে একটি জুতো উড়ে আসে। এক মহিলা পার্থবাবুর দিকে জুতো ছুড়েছিলেন। বলেছিলেন, "এত টাকা ঘুষ খেয়েছে তাই জুতো মেরেছি। বেশ করেছি।"
ওই মহিলার স্বামী জানিয়ে ছিলেন, তাঁদের মেয়ে নার্সিংয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু ভর্তি হতে আট লাখ টাকা দরকার। অত টাকা দেওয়ার মতো ক্ষমতা নিম্নবিত্ত ওই পরিবারের নেই। তাই মেয়ের নার্সিং পড়া হয়নি। এদিকে টিভিতে দেখাচ্ছে শিক্ষা দফতরের নিয়োগ নিয়ে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি। সবকিছু মিলিয়েই নাকি ওই মহিলা এমনভাবে রাগের বহিঃপ্রকাশ দেখিয়েছিলেন। দিন কয়েক আগে চন্দ্রকোণার মেয়ে তিথি দলুই আত্মহত্যা করেছেন। কারণ, তিনি নার্সিংয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু পড়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় আর্থিক সঙ্গতি। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা করা স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডও কাজে আসেনি। লোন পাননি তিথি। তাঁর পরিবার জানান, তাই শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার মতো চরম পথ বেছে নেন।
আরও পড়ুন: দুয়ারে ইডি-সিবিআই! জেলে যেতে পারেন? নেতাদের জন্য রইল শরীর ঠিক রাখার টোটকা
এই দুই ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়। এ রাজ্যের একটি বড় অংশের নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা নার্সিং পড়ে স্বনির্ভর হন। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়। তামিলনাড়ু, কেরলের মতো দেশের একাধিক রাজ্যের মহিলাদের স্বনির্ভর হওয়ার রাস্তা নার্সিং। কিন্তু এ রাজ্যে নার্সিং পড়ার পথে এক বড় অন্তরায় হয়ে উঠেছে দুর্নীতি। নার্সিং পড়ার খরচ গত কয়েক বছরে মারাত্মক বেড়ে গিয়েছে। তবে, ভুক্তভোগীরা জানাচ্ছেন, শুধু কলেজ ফি বাড়েনি। কলেজ ভর্তি হতে নানান জায়গায় টাকা দিতে হচ্ছে। আর তাতেই নাজেহাল হচ্ছেন পড়ুয়ারা।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, রাজ্যে নার্সের চাহিদা যথেষ্ট। স্টাফ নার্সের আসন কয়েক হাজার খালি রয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভিত্তিই এই স্টাফ নার্স। রোগীকে দেখভালের সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব এই স্টাফ নার্সের উপরেই থাকে। সেই চাহিদা পূরণ করতে প্রয়োজন প্রশিক্ষিত নার্স। অথচ গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ জায়গায় নার্সিং কলেজে ভর্তি নিয়ে একটা অস্বচ্ছ হিসাব চলছে।
গত কয়েক বছরে রাজ্যে কয়েক হাজার নতুন বেসরকারি নার্সিং কলেজ গড়ে উঠেছে। সেগুলোতে ভর্তি করার জন্য এক লাগামহীন অর্থ চাহিদাও তৈরি হয়েছে। শুধু মাত্র কোর্স ফি বাবদ নার্সিং কলেজে টাকা দিতে হচ্ছে এমন নয়। অভিযোগ, প্রবেশিকা পরীক্ষার উত্তীর্ণ তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও নার্সিং কলেজে ভর্তির জন্য বিভিন্ন স্তরে টাকা দিতে হচ্ছে। শুধুমাত্র পড়া খরচ বাবদ লক্ষাধিক টাকা নয়। বিভিন্ন স্তরে টাকার জোগান দিতেই কয়েক লাখ টাকা চলে যাচ্ছে নার্সিং পড়ুয়াদের। আর এই সবটাই বেআইনিভাবেই নেওয়া হচ্ছে। টাকা না দিলে ভর্তি হতে পারবে না বলেই সাফ জানিয়ে দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট মহল। কিন্তু কোথাও অভিযোগ জানানোর উপায় নেই।
আরও পড়ুন: রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল নির্বাচন 'নির্মল' হবে কিনা সংশয়ে চিকিৎসকরা
স্বাস্থ্য ভবনের নার্সিং শাখায় কর্মরত কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, সবকিছুই হচ্ছে স্বাস্থ্য ভবনের অঙ্গুলি হেলনে। স্বাস্থ্য ভবন জানে না, এমন নয়। কিন্তু এই টাকার ভাগ অনেক দূর পর্যন্ত যায়। তাই সব জেনেও কোথাও কোনও হেলদোল নেই। শুধুমাত্র বেসরকারি নার্সিং কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রেই যে এত সমস্যা তা নয়। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, ভর্তির তালিকা তৈরির সময় থেকেই একটা অস্বচ্ছতা দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
স্বাস্থ্য ভবনের এক কর্তা জানান, নার্সিং রুল বুকের ন্যূনতম নিয়মও মেনে চলা হচ্ছে না। নার্সিংয়ের সবটাই এখন চলছে বেনিয়মে। তিনি জানান, যাঁরা সাব সেন্টারে পোষ্টেড সেই Health Assistant Female রা ৩ বছর 'uninterrupted' সার্ভিস করলে তাঁদের TR দিয়ে GNM করাবে বলে তথ্যপুস্তিকা প্রকাশ করে রাজ্য জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ড এবং পরীক্ষা নেয়। পরীক্ষার পরে, যারা কৃতকার্য হয়, তারা কাউন্সেলিং করার জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে স্বাস্থ্য ভবনের Nursing ব্রাঞ্চের আধিকারিকদের পরীক্ষায় বসার জন্যে BMOH এর পারমিশন, Rank কার্ড, অ্যাডমিটসহ অন্যান্য ডকুমেন্ট পাঠায়।
প্রথম রাউন্ড কাউন্সেলিং শেষ করার পরও ডিপার্টমেন্টের কোনও হেলদোল ছিল না। TR লিস্ট বার করার, জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ড সিট আপগ্রেডেশন সুবিধা পরীক্ষার্থীদের দেয় তাই সেই সার্ভিস ক্যান্ডিডেটরা দ্বিতীয় রাউন্ড কাউন্সেলিংয়ে বসে যাতে সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখ পর্যন্ত TR এর জন্যে অপেক্ষা করা যায়। এদিকে কলেজ কর্তৃপক্ষ সব সার্ভিস পরীক্ষার্থীদের জানিয়েছে, স্বাস্থ্য ভবন থেকে বলে দেওয়া হয়েছে সার্ভিস ক্যান্ডিডেটদের ভর্তি না করতে করলেও ফ্রেশ ক্যান্ডিডেট হিসেবে ভর্তি করতে, এদিকে ফ্রেশ ক্যান্ডিডেট হিসেবে ভর্তি করলে সার্ভিস ব্রেক হয়ে যাবে হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট ফিমেলদের। ওই কর্তা বলেন, "West Bengal Nursing Personnel (Placement on Trainee Reserve) Rules, 2009, অর্ডার নম্বর. HF/O/GA(NG)/303/1N-26/09 অনুসারে HAF দের TR পাওয়ার কথা, কিন্তু ডিপার্টমেন্ট নিঃশ্চুপ। হয়তো এমন সময় TR বার করবে যখন কোন লাভ নেই আর। হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট ফিমেলদের সঙ্গে এই বিশ্বাসঘাতকতা করাটার কি খুব প্রয়োজন ছিল!"
স্বাস্থ্য দফতরের একাংশের আশঙ্কা, এসএসসির মতো স্বাস্থ্য দফতর নিয়ে কখনো আদালতে তদন্তের নির্দেশ দিলে, তা শিক্ষা দফতরের দূর্নীতিকেও পিছনে ফেলে দেবে।
+ There are no comments
Add yours