মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ফাইল ছবি)
"একজন মহিলা হয়ে যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এধরনের মন্তব্য করেন, তাহলে তিনি মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকার যোগ্য নন...।"
ওপরের বক্তব্যটি কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তি বা কোনও সংবাদমাধ্যম অথবা কোনও আদালতের পর্যবেক্ষণ নয়। কথাটি বলেছেন দেশের এক মা, যিনি ১০ বছর তাঁর সন্তান খুইয়েছেন মানবসমাজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বর্বরদের পৈশাচিক অত্যাচারে। বক্তব্যটি সেই মায়ের, যাঁর মেয়ের ওপর ঘটে যাওয়া নারকীয় অত্যাচারের ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দেশকে। হ্যাঁ, এই কথা বলেছেন নির্ভয়ার মা।
কিন্তু, কেন তাঁকে এই কথা বলতে হল? বা বলা ভাল, কেন তিনি এই কথা বলতে বাধ্য হলেন? গত কয়েকদিন ধরেই হাঁসখালি গণধর্ষণের ঘটনা রাজ্যে খবরের শিরোনামে রয়েছে। শাসক দলের এক স্থানীয় প্রভাবশালী নেতার ছেলের জন্মদিনের পার্টিতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার হতে হয় ১৪-বছরের কিশোরীকে। রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে দিয়ে আসা হয় বাড়িতে।
অভিযোগ, হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাধা দেওয়া হয় অভিযুক্তদের তরফে। শুধু বাধা নয়, ক্রমাগত হুমকি চলতে থাকে। শেষমেশ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জেরে নির্যাতিতা মারা যায়। এখানেই শেষ নয়। কোনওপ্রকার ময়না-তদন্ত ছাড়া, ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া, একেবারে সরাসরি শ্মশানে নিয়ে গিয়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয় নির্যাতিতার মৃতদেহ।
নারকীয় এই ঘটনায় রাজ্যের শাসক শিবির যখন সমালোচনার চক্রব্যূহে, তখন মুখ খুললেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে, কঠোর পদক্ষেপের কথা তাঁর মুখ দিয়ে শোনা গেল না। উল্টে, তিনি কী করলেন? বকলমে, আড়াল করতে চাইলেন দলকে। খাড়া করলেন অন্তঃসত্ত্বা-লাভ অ্যাফেয়ারের তত্ত্ব। শুধু তাই নয়। এও বললেন যে, হতে পারে চড় মারা হয়েছিল কিশোরীকে!
কিন্তু, এই কথা বলার আগে, মুখ্যমন্ত্রী কি একবার ভাবলেন না, তিনি কী বলছেন? প্রশাসনিক কর্তা না হয়ে বাদই দেওয়া হল, একজন মহিলা হিসেবেও তিনি কীভাবে এই কথা বলতে পারেন, সেই নিয়ে তো প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। কোন আঙ্গিকে, তিনি ধর্ষণের (বলা ভাল গনধর্ষণ) মতো গুরুতর ঘটনাকে লাভ অ্যাফেয়ার বলে উল্লেখ করে বসলেন? তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়াও হয়, যে সম্পর্ক ছিল, তাহলে কী ধর্ষণের অপরাধ কমে যায়? না কি তৃণমূল নেতার ছেলে হলে, সাত খুন মাফ হয়ে যায়!
মুখ্যমন্ত্রীর মতে, এখন ইঁদুর মরলেও বড় করে দেখানো হয়। তাহলে কি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর এখন মানুষ আর ইঁদুরের মধ্যে কোনও পার্থক্য করছেন না? নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল তার পরিবারকে, আর স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তাকে এভাবে খাটো করছেন কী করে? প্রকাশ্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুখ্য়মন্ত্রী যে শুধু লাভ অ্যাফেয়ারের তত্ত্ব দিয়েছেন তাই নয়, রাজ্য পুলিশের ডিজি-র উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, কী ডিজি সাহেব, এটা ফ্যাক্ট তো?" পুলিশের ঘাড়ে কটা মাথা আছে, যে খোদ পুলিশমন্ত্রীর মন্তব্যকে প্রকাশ্যে নস্যাৎ বা খারিজ করবেন ডিজি?
আর সংবাদমাধ্যম তো বরাবরই সকলের "সফট টার্গেট"। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, এসব ছোট ঘটনাকে বড় করে দেখিয়ে রাজ্যের ও প্রশাসনের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করছে সংবাদমাধ্য়ম। এর জন্য তিনি সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণও করেন। মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন, আপনার বক্তব্যে কি রাজ্য ও প্রশাসনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হল? তাই যদি হয় ম্যাডাম সিএম, তাহলে নির্ভয়ার মা যে প্রতিক্রিয়া দিলেন, সেটাও কি আপনার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য? প্রশাসনের ওপর ভরসা রাখতে না পেরে, এক সপ্তাহে চার-চারটি মামলা গেল সিবিআইয়ের হাতে। এতে কি রাজ্য প্রশাসনের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হল না?
যদিও, এই প্রথম নয়। ফিরে যাওয়া যাক ঠিক এক দশক আগে। সালটা ২০১২। পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ড নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল রাজ্যে। সেই সময়ও মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টিকে 'সাজানো ঘটনা' বলে উল্লেখ করেছিলেন। সেবারও খাড়া করেছিলেন ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করার তত্ত্ব। শুধু তাই নয়। ধর্ষিতার পেশা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। তখনও তাঁর এই বিরূপ মন্তব্য নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি। বলা হয়েছিল, একজন মহিলা হয়েও কীভাবে তিনি আরেক মহিলা ও ধর্ষিতার বিরুদ্ধে এধরনের মন্তব্য করতে পারেন?
ইতিহাস সাক্ষী আছে, মুখ্যমন্ত্রীর সাজানো ঘটনা তত্ত্বকে গুরুত্ব না দিয়ে পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের সময় তদন্তকারী অফিসার দময়ন্তী সেন নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে এই ঘটনার তদন্ত করেছিলেন। রিপোর্টে ধর্ষণের কথা উল্লেখ করেছিলেন। ফলও পেয়েছিলেন হাতেনাতে। মুখ্যমন্ত্রীর রোষে পড়ে অপসারিত হয়েছিলেন তৎকালীন গোয়েন্দা প্রধান আইপিএস দময়ন্তী সেন। প্রশাসনের (মুখ্যমন্ত্রীর) লাইনের বিরুদ্ধে যাওয়ায় হয়েছিল তাঁকে বদলি করা হয়।
কিন্তু, ওই যে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ১০ বছর পর এই দুঁদে অফিসার, যিনি বর্তমানে কলকাতা পুলিশের স্পেশাল কমিশনারের পদে কর্মরত, তাঁর নজরদারিতে রাজ্যের পৃথক চারটি ধর্ষণের ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। সেই আবার মমতা-জমানায় এবার আদালতের নির্দেশে দেগঙ্গা, মাটিয়া, ইংরেজবাজার এবং বাঁশদ্রোণীতে ধর্ষণ মামলায় আইপিএস দময়ন্তী সেনের নজরদারিতে তদন্ত হবে।