দেশ বিদেশ থেকে পণ্ডিত ও পড়ুয়ারা প্রাচীন ভারতে আসতেন অধ্যয়ন ও গবেষণা করতে
প্রাচীন নালন্দা (সংগৃহীত ছবি)
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: প্রাচীন ভারত ছিল শিক্ষার পীঠস্থান (Ancient Universities of India)। অতীত ভারতের বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় ছিল যা নিয়ে আজও আমরা গর্ব অনুভব করি। পঠনপাঠন শিক্ষাদানের কৌশল- এ সমস্ত কিছুতে প্রাচীন ভারত অনেকটাই এগিয়েছিল। তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নালন্দা ভারতের এই দুই প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় আজও বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সারিতে স্থান পেয়েছে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়। সে সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও ভারতে আসতেন পড়ুয়ারা। দর্শন, গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা, কলা বিদ্যা, প্রভৃতি বিষয়ে পাঠদান চলত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। আজকে আমরা ভারতবর্ষের এমনই কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আলোচনা করব।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়
- জানা যায়, ভারতে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় (Ancient Universities of India) ৪২৭ থেকে ১১৯৭ সাল পর্যন্ত ভারতের উচ্চ শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।
- নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পঞ্চম শতাব্দীতে স্থাপিত হয়েছিল। অবস্থান ছিল বর্তমান দক্ষিণ নেপাল সীমান্তের কাছে উত্তর-পূর্ব ভারতে।
- নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৌদ্ধ বিষয়গুলিতে পাঠদান করা হতো। এর পাশাপাশি চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, রাজনীতি, যুদ্ধবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে সেখানে পাঠদান চলত বলে জানা যায়।
- নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ৮ টি বড় বড় প্রাঙ্গণ ছিল। দশটি মন্দির ছিল। ধ্যান ঘর ছিল, আলাদা আলাদা বিষয়ে পাঠদানের জন্য শ্রেণীকক্ষ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই ছিল হ্রদ। সময় কাটানোর জন্য পার্কও ছিল। একটি নয় তলা লাইব্রেরী ছিল, যেখানে সন্ন্যাসীরা হাতে লিখে বিভিন্ন বইকে অনুবাদ করতেন।
- নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসও ছিল। সেখানে ১০,০০০ এরও বেশি ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। জানা যায়, অধ্যাপকদের থাকার জন্য সেখানে আবাসন গড়ে উঠেছিল এবং এগুলিতে দুই হাজারেরও বেশি অধ্যাপক থাকতেন।
- নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোরিয়া, জাপান, চিন, তিব্বত, ইন্দোনেশিয়া, তৎকালীন পারস্য বা বর্তমান দিনের ইরান, তুরস্ক সহ অন্যান্য দেশ থেকে পন্ডিত ও ছাত্ররা আসতেন বলে জানা যায়।
- বর্তমান দিনে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় (Ancient Universities of India) হদিশ মেলে রাজগীর থেকে ঠিক আধাঘন্টা বাসযাত্রার করলেই। এখানে পাওয়া যায় বৌদ্ধ ধর্মের সারিপুত্রের স্তূপ। এগুলোতেই সন্ন্যাসীরা থাকতেন এবং পড়াশোনা করতেন বলে জানা যায়।
- নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। চিন থেকে এসেছিলেন হিউয়েন সাং। অন্যান্য বিদেশী পর্যটকরাও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণা করতেন।
- ৭০০ বছর ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয় ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করেছিল। কিন্তু দ্বাদশ শতকে ইখতিয়ারউদ্দিন বখতিয়ার খিলজি, এই বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীকেও তিনি জ্বালিয়ে দেন। তখনই ধ্বংস হয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়।
- উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে খননকার্য শুরু হয় এবং সেখান থেকেই বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে।
- নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণটি বর্তমানে সরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণ করা হয়েছে। সেখানে একটি ছোট জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে।
তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়
- তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতবর্ষের অন্যতম একটি প্রাচীন শিক্ষা কেন্দ্র। জানা যায় খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে এই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে।
- পঞ্চম শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে সে সময় জাতকের গল্পে তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।
- তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে জড়িয়ে রয়েছে চাণক্যের নাম, যিনি বিখ্যাত অর্থশাস্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় বহু শতাব্দী ধরে শিক্ষা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল ভারত সহ বিশ্বে।
- জানা যায়, তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেদ কলা বিভাগের বিভিন্ন বিষয়, আইন শাস্ত্র, চিকিৎসা, সামরিক বিজ্ঞান- এ সমস্ত কিছুতেই শিক্ষা প্রদান করা হত।
- তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষের খোঁজ পাওয়া যায় তিনটি আলাদা আলাদা শহরে।
- তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেখানে অবস্থিত ছিল তার আশেপাশে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহার ও স্তুপ।
- জানা যায়, রাজা তক্ষ বা তক্ষকের নামানুসারেই শহরের নাম হয় তক্ষশীলা এবং সেখান থেকেই তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়।
- হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের কাছে তক্ষশীলার ব্যাপক ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষত, বৌদ্ধ ধর্মের মহাজান সম্প্রদায়ের বিকাশে তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল বলে মনে করা হয়।
- চাণক্য, সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং চরকের মতো খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরা তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
ওদন্তপুরী বিশ্ববিদ্যালয় (Ancient Universities of India)
- দেশের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, বিহারে অবস্থিত ওদন্তপুরী বিশ্ববিদ্যালয়। পাল রাজবংশের রাজা প্রথম গোপালের সময় এটি নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়।
- ওদন্তপুরী বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধ মহাবিহার হিসেবে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার কেন্দ্র ছিল এবং তা মঠ হিসেবেও কাজ করতো
- কিন্তু পরবর্তীকালে মুসলিম আক্রমণে ওদন্তপুরীদের সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয় এই আক্রমণ করেন
বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয়
- জানা যায়, বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমান বিহারের ভাগলপুর জেলায় অবস্থিত। পাল বংশের রাজা ধর্মপাল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপন করেছিলেন।
- জানা যায়, বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের জন্য শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বব্যাপী বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার হয়েছিল।
- বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় চলত বৌদ্ধ ধর্মের বজ্রযান মত অনুসারে।
- বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন বিষয় অধ্যয়নের পাশাপাশি এখানে যুক্তিবিদ্যা, বেদ, জ্যোতির্বিদ্যা, নগর পরিকল্পনা, আইন, ব্যাকরণ দর্শন সমেত অন্যান্য বিষয়ে পাঠদান চলতো।
জগদ্দল বিশ্ববিদ্যালয় (Ancient Universities of India)
- বাংলায় অবস্থিত ছিল জগদ্দল বিশ্ববিদ্যালয়। জানা যায়, বৌদ্ধ ধর্মের বজ্রযান সম্প্রদায়ের মত অনুসারে এই বিশ্ববিদ্যালয় পাঠদান চলত।
- নালন্দা ও বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম আক্রমণে ধ্বংস হওয়ার পরে অসংখ্য পণ্ডিত জগদ্দল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন বলে জানা যায়।
- রাজবংশের রাজা রামপাল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
ভালভী বিশ্ববিদ্যালয়
- গুজরাটের সৌরাষ্ট্রে অবস্থিত হল ভালভী বিশ্ববিদ্যালয়। বৌদ্ধ ধর্মের হীনযান মত অনুসারে এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হত।
- প্রশাসন, শিল্প, আইন, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ক পাঠদান করানো হত এখানে।
- চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেন।
কাঞ্চীপুরম বিশ্ববিদ্যালয়
- প্রথম শতাব্দীতে নির্মিত কাঞ্চীপুরম বিশ্ববিদ্যালয় হিন্দু ধর্ম, জৈন ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।
- জানা যায়, পল্লব রাজবংশের আমলে এই বিশ্ববিদ্যালয় খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
মানখেতা বিশ্ববিদ্যালয়
- মানখেতা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমান কর্ণাটকে মালখেত নামে পরিচিত।
- রাষ্ট্রকূট রাজবংশের আমলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি দুনিয়া ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে বলে জানা যায়।
পুষ্পগিরি বিহার ও ললিতগিরি
- ওড়িশার পুষ্পগিরি বিহার এবং ললিতাগিরি খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে কলিঙ্গ রাজাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে জানা যায়। উদয়গিরি পাহাড়ের কাছে বৌদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি গড়ে উঠেছিল।
শারদা পীঠ
- শারদা পীঠ বর্তমানে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে অবস্থিত। এটি সংস্কৃত শিক্ষাবিদদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল।
- দেবী শারদাকে উৎসর্গ করে তৈরি করা হয়েছিল এই পীঠ। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস এখানে স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব বাস করেন।
নাগার্জুনকোন্ডা বিশ্ববিদ্যালয়
- অন্ধ্রপ্রদেশের অমরাবতী থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নাগার্জুনকোন্ডা একটি বিখ্যাত বৌদ্ধ কেন্দ্র ছিল।
- শ্রীলঙ্কা, চিন সহ বিভিন্ন দেশের পণ্ডিতরা এখানে এসেছিলেন বলে জানা যায়।
- নাগার্জুনকোণ্ডা নামটি দক্ষিণ ভারতের একজন বিশিষ্ট মহাযন বৌদ্ধ শিক্ষক নাগার্জুনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তৈরি হয়েছিল।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।