মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: বাংলায় কাজ নেই তাই রোজগারের আশায় উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি রাজ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন পাঁচ তরতাজা বাঙালি যুবক। সেখানেই পাথর-খাদানে ধস নেমে সমাধিস্থ হলেন নদিয়া জেলার চার বাসিন্দা। তেহট্ট কালীতলা পাড়ার বুদ্ধদেব মণ্ডল (২৫), মিন্টু মণ্ডল (২২) ও রাকেশ বিশ্বাস (২১) এবং চাপড়া পিঁপরেগাছির বাসিন্দা মদন দাস। মৃতদের মধ্যে রয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালির ঢোলখালি গ্রামের বাসিন্দা সুব্রত রপ্তান (২৪)। একটি ঠিকাদার সংস্থার অধীনে মিজোরামে জাতীয় সড়ক নির্মাণের কাজ করতে যান তাঁরা। রাস্তা নির্মাণের সময় খাদান থেকে পাথর আনার কাজ করছিলেন ১৩ জন। তাঁদের মধ্যেই ছিলেন বুদ্ধদেবরা।
মৃতদের পরিচয়
টাকি গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে স্নাতক হয়েছিলেন বছর চব্বিশের সুব্রত রপ্তান। তেমন কোনও চাকরি না পেয়ে পরিবারের আর্থিক অনটন মেটাতে শ্রমিকের কাজ জোগাড় করে চলে যান ভিন্ রাজ্যে। ছেলে কাজ পাওয়ায় পরিবারের কিছুটা আর্থিক সুরাহা হয়েছিল। আগে ঝাড়খণ্ডে পাথর খাদানে কাজ করেছেন। দুর্গাপুজোয় বাড়ি এসেছিলেন। ভাইফোঁটার পরে ফের কাজে যান। এবার গন্তব্য ছিল মিজোরাম। সুব্রতের বাবা শ্যামল তামিলনাড়ুতে শ্রমিকের কাজ করেন। দুই দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বাড়িতে মা মালতি একাই থাকেন। কিন্তু এখন সব শেষ। সোমবার সন্ধ্যায় সুব্রতর এক বন্ধু বাড়িতে দুর্ঘটনার খবর দেন। এবার সুব্রতর নিথর দেহ কফিনবন্দি হয়ে সন্দেশখালির গ্রামের বাড়িতে ফিরবে। সুব্রতর কাকিমা অনিমা রপ্তান বলেন, ‘‘কোনও কাজ না পেয়ে সুব্রত শ্রমিকের কাজে যেতে বাধ্য হয়েছিল। দেহ বাড়িতে আনার ক্ষমতাও নেই ওঁদের।’’
একুশ বছরের ছেলে রাকেশ বিশ্বাসকে হারিয়ে বাবা কালু বিশ্বাসের কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘‘এখানে কোনও কাজ পাচ্ছিল না। তাই ওরা কাজে যায়। ওর জামাইবাবুর সঙ্গে রবিবার শেষ কথা হয়। আজ এই খবর পেলাম।’’ বুদ্ধদেবের বাবা মধুসূদন মণ্ডলের বক্তব্য, ‘‘ঠিকাদার সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজে গিয়েছিল। তার পর আর কোনও যোগাযোগ হয়নি। আজ ঠিকাদার সংস্থার তরফ থেকে খবর পেয়ে জানতে পারলাম যে,ও আর বেঁচে নেই।’’ওই ঠিকাদারি সংস্থায় কাজ করতেন স্থানীয় আরেক যুবক অমিত মণ্ডল। তিনি ছুটিতে বাড়ি ফিরেছিলেন। দুপুরে তাঁকেই ফোন করে মৃত্যুর খবর দেন সংস্থার কোনও আধিকারিক। অমিত জানান, ‘‘ছুটিতে বাড়ি না এলে আমারও হয়তো একই ভাবে মৃত্যু হত।’’
চাকরির সন্ধানে সুকতলা ক্ষয়ে যায়
শিক্ষিত বাঙালি যুবকদের কি এই পরিণতিই ভবিতব্য? ভিন্ রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে কাজে গিয়ে প্রাণ হারানো। এই ঘটনাই প্রথম নয় এবং দুর্ভাগ্যবশত এটাই শেষ ঘটনা হবে এমনটা নয়। এক বছরেই রয়েছে এমন বহু করুণ ঘটনা।
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২: ভিন রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় উত্তর দিনাজপুর জেলার চার পরিযায়ী শ্রমিকের। মৃত শ্রমিকদের নাম হাকিমুল শেখ, আব্দুল্লা শেখ, মহম্মদ রাহুল ও মকিম আলম। এঁদের মধ্যে তিন জনের বাড়ি উত্তর দিনাজপুর জেলার চাকুলিয়া থানার সিরসি গ্রামে এবং একজনের বাড়ি ডুমুরিয়া এলাকায়। মধ্যপ্রদেশের ঝাঁসি স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে পিক-আপ ভ্যান উল্টে গিয়ে তাঁদের মৃত্যু হয়। চার জনেই পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে মধ্যপ্রদেশ গিয়েছিলেন।
১৮ এপ্রিল, ২০২২: দক্ষিণ কর্নাটকের বাজপেয়ী থানা এলাকায় শ্রী উল্কা লিমিটেড নামে এক মাছের সংস্থায় কর্মরত ছিলেন দেগঙ্গার প্রায় ৩০ জন বাসিন্দা। সেখানে প্যাকেজিং এর কাজ করতেন তাঁরা। এদের মধ্যে কয়েকজন একটি ম্যানহোলে ড্রেন পরিস্কার করতে নেমেছিলেন। ম্যানহোলের ভিতরে বিষাক্ত গ্যাসের কবলে পড়েন তাঁরা। মৃতরা হলেন ওমর ফারুক(৩১), সামিউল ইসলাম(১৭) নুর নগর গ্রাম পঞ্চায়েতের ফাজিলপুরের বাসিন্দা, নিজামুদ্দিন সাহাজি (১৯) আমুলিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের রায় পুরের বাসিন্দা, সরাফাতা আলি (২২) ও মিরাজুল ইসলাম (২৩) দেগঙ্গা এক নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের দোগাছিয়ার বাসিন্দা।
১২ মে, ২০২২: মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া থানার প্রদীপ ডাঙা বেলতলা পাড়া এলাকার বছর কুড়ির বাসিন্দা কবিরুল শেখ বেঙ্গালুরুতে পাইপ লাইনের কাজে গিয়েছিলেন। ওই পরিযায়ী শ্রমিক কাজের সাইটে পাইপ লাইনের কাজ করছিলেন একটি বাড়ির দ্বিতীয় তলায়। সেই সময় কাজ করতে গিয়েই তিনি কোনওভাবে বিদ্যুতের তারের উপর পড়ে যান। তাঁর হাতে ছিল লোহার পাইপ। বিদ্যুতের তারে পড়ে গিয়েই বিদ্যুৎপৃষ্ট হন তিনি। অন্যান্য শ্রমিকরা তাঁকে উদ্ধার করে স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যান। চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
২৮ মে, ২০২২: পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী, মুর্শিদাবাদের জলঙ্গী ব্লকের ফরিদপুর অঞ্চলের ইদুল হাসান (৫২) কেরলে প্রেম্বাবুর থানা এলাকায় মারা যান। পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করতেন তিনি।
১০ জুন, ২০২২: মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলা থানার রামগড় পূর্ব হাট পাড়ার বাসিন্দা মোহনলাল মহলদার (২৩) মৃত্যু হল গুজরাটে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করতে গিয়ে। গুজরাটের জামনগর অডিনার জেটিতে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজে গিয়েছিলেন মোহনলাল। জেটির ওপর কাজ করার সময় অসাবধানতার ফলে মাথায় রডের আঘাত লেগে জেটির ওপর থেকে সমুদ্রে পড়ে যান উনি। অন্যান্যরা উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২: বীরভূমের নলাহাটি থানার শীতল গ্রামের বাসিন্দা পিন্টু মাল (২৮) মুম্বইয়ের একটি আবাসনে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করছিলেন। সেই সময়ে মাথায় খসে পড়ল চাঙর। আহত অবস্থায় সঙ্গে সঙ্গে পিন্টুকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাঁকেও মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।
৭ নভেম্বর, ২০২২: নামখানা ব্লকের হরিপুর এলাকার বাসিন্দা রাজেশ মণ্ডল, কেরলে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করতে গিয়ে লিফট থেকে পড়ে গিয়ে মারা যান। রাজেশ যে বহুতলে কাজ করছিলেন সেই বহুতলের লিফটের একটি তার ছিঁড়ে যায়। সহকর্মীরা তড়িঘড়ি রাজেশকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
আরও পড়ুন: সীমান্তে ‘বিপজ্জনক’ ২৩৩ মাদ্রাসার হদিশ রাজ্য গোয়েন্দা বিভাগের, নবান্ন চুপ
হিমশৈলের চূড়া মাত্র
এরকম ঘটনা প্রতিনিয়ত ভুরি ভুরি ঘটছে। যে ঘটনাগুলির উল্লেখ করা হয়েছে তা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলার প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ পরিযায়ী শ্রমিকের কাজে নিযুক্ত। এতদিন জানা যেত যে গুজরাট, তামিলনাড়ু, কেরল, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র হলো বেশির ভাগ পরিযায়ী শ্রমিকদের গন্তব্য। মিজোরামের পাথর খাদানের দুর্ঘটনা বাংলার কর্মসংস্থানের দৈন্যদশা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। দক্ষিণ মিজোরামের যে প্রত্যন্ত এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে সেখানে কলকাতা থেকে পৌঁছতেই লেগে যাবে প্রায় ৩-৪ দিন। আজ বাঙালির দুর্ভাগ্য যে প্রাণ হাতে নিয়ে এই রকম সুদূর দুর্গম এলাকায় ছুটে যেতে হচ্ছে রুজি রোজগার ও সংসারের অনটন মেটানোর জন্য। মিজোরাম কর্মসংস্থান যোগাচ্ছে বাংলাকে, এটাই হচ্ছে সাড়ে তিন দশকের বামফ্রন্ট শাসনের ও সাড়ে ১১ বছরের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজত্বের প্রাপ্তি।
সত্যই মানবিক!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের "মানবিক" মুখ কিন্তু এই ঘটনাতেও প্রচারের আলোয়। ট্যুইট করে উনি সমবেদনা জানিয়েছেন ও শোকপ্রকাশ করেছেন; ‘‘মিজোরামে পাথরখাদানে ধস নেমে পশ্চিমবঙ্গের পাঁচ শ্রমিক-সহ মোট ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনায় আমি গভীরভাবে শোকাহত। আমরা পাঁচ শ্রমিকের দেহ আনার ব্যাপারে মিজোরাম সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। মৃতদের পরিবারকে সবরকম সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। যাঁরা প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, তাঁদের প্রতি আমার সমবেদনা।’’
Deeply anguished by the stone quarry collapse in Mizoram that has resulted in the death of 12 workers, including 5 from WB.
— Mamata Banerjee (@MamataOfficial) November 15, 2022
We're in touch with the Govt of Mizoram to bring back the bodies & have assured the families of support.
My condolences to those who lost their loved ones
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরেই মঙ্গলবার সুব্রতর বাড়িতে আসেন সন্দেশখালি পঞ্চায়েতের প্রধান দিলীপ মল্লিক, সন্দেশখালি ২ যুগ্ম বিডিও অর্ক মান্ডি। বিডিও অর্ণব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘জেলা প্রশাসন উদ্যোগ নিয়েছে, দেহ বিমানে করে এ রাজ্যে আনার। পরিবারটি যাতে ক্ষতিপূরণ পায়,তা প্রশাসন দেখছে।’’অর্থাৎ যে বিএ পাস করা যুবক কাজের অভাবে ৩-৪ দিনের পথ অতিক্রম করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাথর খাদানে কাজ করতে গিয়ে মারা গেলো তার নিথর দেহ কয়েক ঘণ্টায় বিমানে করে কলকাতায় এনে বাড়ি পৌঁছে দিয়েই সরকার তার দায়িত্ব পালন করে ফেলবেন এবং হয়তো আগামী বছরের কোনো "স্কচ অ্যাওয়ার্ড" পেয়ে যাবেন এতটা মানবিক হওয়ার জন্য।
কোটি টাকার প্রশ্ন
এই সরকারই দাবি করে যে পশ্চিমবঙ্গে নাকি চল্লিশ শতাংশ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হয়েছে। খাতায় কলমে হয়তো হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন কোথায়? এমন দুর্ঘটনার খবর রোজ প্রকাশিত হয় না, কারণ তা মূলধারার সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় না। যদি প্রতিদিন এমন খবর খোঁজ নিয়ে প্রকাশিত করা যেত তাহলে জনমানসে তার প্রভাব ফেলতে কোনো মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তি প্রাঙ্গণ, গান্ধী মূর্তির পাদদেশ অথবা করুণাময়ীর বিকাশ ভবনের সামনে অনশন বিক্ষোভ কর্মসূচি করতে লাগতো না। বেকারত্বের এমন বিজ্ঞাপন বাঙালিদের বিবেকবোধকে নাড়িয়ে দিত।
বাঙালির এই দুর্দশা কবে ঘুচবে তা কেউ জানে না। সরকার বদলে গেলেও প্রায় ৫০ বছরের এই গভীর ক্ষত সরিয়ে তুলতে যে সময় ব্যয় হবে তাতে আর কটা প্রজন্মকে ভুগতে হবে সেটাই কোটি টাকার প্রশ্ন।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook এবং Twitter পেজ।
+ There are no comments
Add yours