১৫ বছর জারোয়াদের মাঝে এক বাঙালি চিকিৎসক! পেলেন পদ্মশ্রী সম্মান
জারোয়া পরিবারের সঙ্গে এভাবেই একাত্ম হয়ে উঠেছিলেন ডাক্তার রতনচন্দ্র কর। সংগৃহীত ছবি
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: সমগ্র পৃথিবীর এমন অনেক উপজাতি বা আদিবাসী গোষ্ঠী আছে, যাঁরা এখনও সভ্য সমাজের আলোতে পৌঁছাতে পারেনি। সেরকমই ভারতীয় উপ মহাদেশের এক জাতিগোষ্ঠী হল জারোয়া, যাঁদের বসবাস দক্ষিণ আন্দামান এবং মধ্য আন্দামানের পূর্ব দিকে। এই আদিবাসী গোষ্ঠী (Jarawas) তাঁদের অঞ্চল ছাড়া বাকি সভ্য সমাজের সাথে যে কোনও রকম সম্পর্ক রাখা এড়িয়ে চলে। তাঁরা নিজস্ব সমাজ, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বর্তমানে এই আদিবাসী গোষ্ঠীর আনুমানিক সংখ্যা ২০০ থেকে ৪০০-র মধ্যে। এই জারোয়া নামের অর্থ "পৃথিবীর মানুষ"। শুনলে অবাক হবেন, এক বাঙালি ডাক্তার এই জারোয়া আদিবাসী গোষ্ঠীর সাথে জড়িয়ে ছিলেন দীর্ঘ সময় ধরে।
কী পরিচয় এই ডাক্তারের?
ডাক্তার রতনচন্দ্র কর একজন জেনারেল ফিজিশিয়ান এবং কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের একজন প্রাক্তন ছাত্র। তিনি আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে একজন স্বাস্থ্য আধিকারিক হিসেবে কাজ করেছেন এবং দীর্ঘ সময় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের জারোয়া উপজাতিদের (Jarawas) সামনে থেকে চিকিৎসা করেছেন। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে থাকাকালীন নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি "জারোয়াস অফ দ্য আন্দামান" নামক একটি বইও লেখেন। ভারত সরকার সাম্প্রতিক বছরে তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করেছে।
কীভাবে তিনি জারোয়াদের (Jarawas) সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন?
প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী, জারোয়া (Jarawas) উপজাতিরা যেহেতু সভ্য সমাজ থেকে অনেকটাই পিছিয়ে, তাই এঁরা সভ্য সমাজের মানুষদের সাথে সম্পর্ক রাখা এড়িয়ে চলে। ১৯৯৮ সালে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে হামের মতো রোগের প্রাদুর্ভাব খুব বেড়ে যায়। সেই সময় ডক্টর রতনচন্দ্র কর নিজে সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে জারোয়াদের মধ্যে উপস্থিত থেকে তাঁদের সামনে থেকে চিকিৎসা করেন। তিনি জারোয়াদের এই সময় খুব সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু এটি মোটেও প্রথমে সহজ কাজ ছিল না। যখন জারোয়ারা হামের মতো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করে, তখন অনেকে মারাও গিয়েছিল। এই ঘটনাটি উপজাতি পরিদর্শনকারী কল্যাণ কর্মকর্তাদের নজরে এলে কেন্দ্র সরকারকে তাঁরা অনুরোধ করে, তাঁদের চিকিৎসার জন্য একজন ডাক্তার নিয়োগ করার। এই সূত্রেই ডাক্তার রতনচন্দ্র করের জারোয়াদের সাথে সংযোগ স্থাপনের ভিত তৈরি হয়।
প্রথম দিন জারোয়াদের (Jarawas) মাঝে পৌঁছানোর অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
ডাক্তার রতনচন্দ্র কর যেদিন প্রথম জারোয়া দ্বীপে গিয়ে পৌঁছান, সেদিন তিনি লক্ষ্য করেন, তীর-ধনুক হাতে অনেক জারোয়া তাঁর দিকে সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। প্রথমে মনে হয়েছিল, তাঁরা যেন সভ্য সমাজের মানুষ দেখে ভীত। কিন্তু সেই উপদ্বীপে থাকা জারোয়া (Jarawas) বাচ্চাদের জন্য ডাক্তার নারকেল এবং কলা নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের উপহার দেওয়ার জন্য। সেই উপহার দেওয়াতে তাঁদের ডাক্তারের ওপর বিশ্বাস জন্মায় এবং তাঁকে একটি কুঁড়ে ঘরে নিয়ে যায় তাঁরা। সেখানে তাঁকে মাংস রান্না করে খাওয়ায় জারোয়ারা। এদের কাছে জারোয়া ভাষা শিখেছিলেন তিনি, যাতে আরও ভালো সংযোগ স্থাপন করতে পারেন।
ভাষার সমস্যা কীভাবে কাটালেন?
জারোয়াদের আস্থা অর্জন এবং তাঁদের সাথে তাদের মতানুযায়ী আচরণ করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না ডাক্তারের পক্ষে। সেখানকার সমস্ত মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য তাঁকে এক দরজা থেকে আরেক দরজাতে ভিজিট করতে হয়েছিল। সেখানে ছিল ভীষণ ভাষার বাধা। তাই তাঁদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে অনেক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছিল। আস্তে আস্তে তিনি তাঁদের চিকিৎসার জন্য তাঁদের বিশেষ সম্মান প্রদান করেন এবং ওষুধগুলির সঠিক ব্যবহার তাঁদেরকে শেখাতে শুরু করেন। এসবের মাঝেই কয়েক মাসের মধ্যে তিনি জারোয়া ভাষা শিখেছিলেন এবং এক বছরের মধ্যে তিনি সাবলীল ভাবে জারোয়া (Jarawas) ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন। অপরদিকে জারোয়াদেরও তিনি অনেক বাংলা ভাষা শিখিয়েছিলেন। আস্তে আস্তে ডাক্তারের প্রতি এবং তাঁর চিকিৎসার প্রতি জারোয়ারা সম্মান প্রদর্শন করতে থাকে এবং খুব পরিচিত এবং কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন তিনি।
পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত
ডাক্তার রতনচন্দ্র কর এই জারোয়া (Jarawas) দ্বীপে ১৯৯৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তাঁদের সেবায় এবং চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন। এখনও পর্যন্ত সেখানকার মানুষ তাকে মনে রেখেছে।
সম্প্রতি ২০২৩ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করেছে এবং তিনি বর্তমানে জারোয়াদের ডাক্তার নামেই পরিচিতি লাভ করেছেন।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook, Twitter এবং Google News পেজ।