মাত্র ৩২ বছরের জীবন কালে সারাদেশে হিন্দুধর্মের নবজাগরণ এনেছিলেন
আদি শঙ্করাচার্য
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: আধ্যাত্মিক ভূমি ভারতবর্ষে যুগে যুগে আবির্ভাব ঘটেছে মহান সন্ন্যাসীদের। যাঁদের উপদেশ, শিক্ষাদান এবং কর্মে প্রভাবিত হয়েছে এদেশের বৃহত্তর সমাজ। ভক্তদের কাছে আজও সমান ভাবে তাঁরা শ্রদ্ধেয়, সমাদৃত এবং পূজনীয়। আদিগুরু শঙ্করাচার্য, মাত্র ৩২ বছরের জীবন কালে সারাদেশে হিন্দুধর্মের নবজাগরণ এনেছিলেন। ভক্তরা তাঁকে ভগবান শিবের অবতার মানেন। চলতি বছরে আদিগুরু শঙ্করাচার্যের আর্বিভাব তিথি ২৫ এপ্রিল।
অষ্টম শতাব্দীর সেই সময়টায়, দেশের ধর্মীয় জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে নানা কুসংস্কার প্রবেশ করেছে। বৌদ্ধ ধর্মের তন্ত্রবিদ্যা, কালাজাদুতে তখন দেশে অন্ধকারময় যুগ নেমে এসেছে। হিন্দু ধর্ম তখন সংকটে। এই যুগসন্ধিক্ষণে ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের বৈশাখী শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে দক্ষিণ ভারতের কেরল রাজ্যের কালাডি গ্রামে শঙ্করাচার্য জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শিবগুরু ও মাতা আর্যাম্বা। কথিত আছে, শিবগুরু শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ এবং শিবভক্ত ছিলেন। শোনা যায়, গ্রামে দানধ্যান করার জন্য ব্রাহ্মণ দম্পতির যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। জানা যায়, গ্রামে ছিল চন্দ্রমৌলীশ্বর শিবের মন্দির। সেই মন্দিরে স্বামী স্ত্রী প্রতি দিনই পুত্র সন্তানের জন্য প্রার্থনা করতেন। দেবাদিদেব মহাদেবের আশীর্বাদে কালাডি গ্রামের ওই নাম্বুদ্রি দম্পতি এক পুত্র লাভ করেন। শিবের এক নাম শঙ্কর। আবার অন্য একটি মত হল, শঙ্কর (Adi Shankaracharya) শব্দের অর্থ হল সমৃদ্ধিদাতা। তাই পুত্রের নাম রাখা হল শঙ্কর। শৈশবেই পিতৃহীন হন শঙ্কর। মেধাবী, স্মৃতিধর শঙ্কর অল্পদিনের মধ্যেই আয়ত্ত করে ফেলেন হিন্দুধর্মের জটিল তত্ত্বগুলি। জীবনের উদ্দেশ্য তখনই তিনি ঠিক করে ফেলেছেন, সন্ন্যাস জীবন। কিন্তু মা আর্যাম্বার তাতে সায় নেই।
কিংবদন্তি অনুসারে, পিতার মৃত্যুর পর তাঁর মায়ের সঙ্গে প্রতিদিনই নদীতে স্নান করতে যেতেন বালক শঙ্কর (Adi Shankaracharya)। এদিকে সন্ন্যাস নেওয়ার প্রবল ইচ্ছা, কিন্তু মায়ের অনুমতি ছাড়া তিনি সন্ন্যাসও নিতে পারছেন না। স্নান করার মুহূর্তে একদিন ঘটল বিপত্তি, যাকে অলৌকিক কান্ডও বলা যেতে পারে। হঠাৎই বালক শঙ্করের পা' টেনে নিয়ে যেতে থাকল একটি কুমির।
মাতা আর্যাম্বার পক্ষে সম্ভব ছিলনা, কুমিরের মুখ থেকে নিজের সন্তানকে উদ্ধার করার। হঠাৎই বালক শঙ্কর (Adi Shankaracharya) শেষবারের মতো মা'কে জিজ্ঞেস করলেন, সন্ন্যাসী হওয়ার অনুমতি দেবে? তাহলে কুমির আমায় ছেড়ে দেবে! নিরুপায় আর্যাম্বা দেবী অনুমতি দিলেন, কিন্তু বললেন, তুমি আমার সন্তান। সন্ন্যাসীদের পরিবার থাকেনা, আমার শেষকৃত্যে তুমি অবশ্যই উপস্থিত থেকো। পরক্ষণেই শঙ্কর জপ শুরু করেন এবং কুমির তাঁর পা ছেড়ে দেয়। এভাবেই তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন।
মায়ের অনুমতি নিয়ে শঙ্কর তাঁর জন্মস্থান ছাড়লেন। গুরুর সন্ধানে একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত হাঁটতে থাকলেন। অবশেষে পেলেন সন্ধান। গুরু গোবিন্দপাদ। শিষ্যদের বিশ্বাসে তিনি ছিলেন পূর্বজন্মে মহর্ষি পতঞ্জলি। গোবিন্দপাদ শিষ্যরূপে গ্রহণ করলেন শঙ্করকে। শঙ্করাচার্য (Adi Shankaracharya) হয়ে ওঠার যাত্রা শুরু হল কালাডির শঙ্করের। অসামান্য পাণ্ডিত্যের অধিকারী হয়ে তিনি বের হলেন ভারত পরিভ্রমণে।
আদিগুরু শঙ্করাচার্য (Adi Shankaracharya) হিন্দু ধর্মকে একসূত্রে গাঁথার জন্য দেশের চারকোণায় চারটি মঠ স্থাপন করেন। দক্ষিণে কর্ণাটকের শৃঙ্গেরীতে, পশ্চিমে গুজরাটের দ্বারকায়, পূর্বে ওড়িশার পুরীতে গোবর্ধন মঠ এবং উত্তরে উত্তরাখন্ডের জ্যোতির্মঠে (জোশীমঠ)। তাঁর চারজন শিষ্যকে তিনি এই চারটি মঠের দায়িত্ব দেন। তাঁরা হলেন, সুরেশ্বরাচার্য, হস্তামলকাচার্য, পদ্মপাদাচার্য এবং তোটকাচার্য। আজও চারটি মঠের প্রত্যেক প্রধান আদিগুরু শঙ্করাচার্যের নামানুসারে শঙ্করাচার্য (Adi Shankaracharya) উপাধি গ্রহণ করেন।
অদ্বৈত বেদান্তের কথাই প্রচার করে গেছেন শঙ্করাচার্য (Adi Shankaracharya)। তাঁর মতে, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। তিনি মনে করতেন 'সঠিক বিদ্যা না থাকার ফলে মানুষ ব্রহ্মকে বুঝতে পারে না'। আত্মাই হল ব্রহ্ম । এই ব্রহ্ম নির্গুণ এবং আনন্দময় । কিন্তু ব্রহ্ম আবার পারমার্থিক দৃষ্টিতে ব্রহ্ম হলেও ব্যবহারিক দৃষ্টিতে ঈশ্বর বলে প্রতিভাত হয় । অবিদ্যা ব্রহ্মের শক্তিবিশেষ যার ফলে জীব নিজেকে ব্রহ্মের থেকে ভিন্ন মনে করে । প্রকৃতপক্ষে , জীবাত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন। অসংখ্য ভাষ্য রচনা করে গেছেন তিনি। মহাভারত থেকে গীতাকে আলাদা তিনিই করেন। হিন্দু ধর্মে বিভিন্ন দেবদেবীর উপর স্তোত্র রচনাও করে গেছেন তিনি। হিন্দুদের তিনখানি অন্যতম প্রধান ধর্মগ্রন্থ হল উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র ও ভাগবত গীতা। এই তিনটি বইয়ের উপর শঙ্করাচার্য (Adi Shankaracharya) যে ভাষ্য বা টীকা লিখেছিলেন, তা খুবই বিখ্যাত এবং হিন্দু ধর্মে আজও সমান জনপ্রিয়। এছাড়া কয়েকটি দর্শন গ্রন্থও রচনা করেছিলেন তিনি। গবেষকদের মতে, সেসময় হিন্দুধর্ম নানাভাবে পিছিয়ে পড়েছিল। শঙ্করাচার্য (Adi Shankaracharya) সেই পিছিয়ে পড়া হিন্দুধর্মের নবজাগরণ ঘটাতে সক্ষম হন।
ভক্তরা এদিন সকালে উঠে স্নান করে, নতুন পোশাক গায়ে চড়িয়ে ভগবান শিবের পুজো করেন। উপোস করার রীতিও দেখা যায় শঙ্কর জয়ন্তীতে। এদিন শিব ছাড়াও লক্ষীদেবী, গণেশ, ভগবান বিষ্ণুরও পুজো হয়। দেশের অসংখ্য মঠ এবং মন্দির যেগুলি শঙ্করাচার্যের (Adi Shankaracharya) নামে নামাঙ্কিত সেগুলিতে ভক্তরা সকাল থেকেই ভিড় করেন।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook, Twitter এবং Google News পেজ।