ভাইফোঁটা হল ভাই ও বোনের মঙ্গল কামনার ব্রত...
ভাই-বোনের মঙ্গল কামনার উৎসব (ছবি-সংগৃহীত)
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: জলযোগে লুচি, আলুর দম, ফুলকপির তরকারি সঙ্গে বিভিন্ন রকমের মিষ্টি। দুপুরে মাংস অথবা মাছ-ভাত। ভাইফোঁটা মানেই যে কোনও বাঙালি বাড়ির পাতে এগুলো থাকবেই। সাধারণত কালীপুজোর দুদিন পর সম্পন্ন হয় ভাইফোঁটা (Bhai Phonta)। এদিন সকাল থেকেই বাঙালি বাড়িতে ব্যস্ততা তুঙ্গে ওঠে। একদিকে জলযোগের আয়োজন তো অন্যদিকে সাজগোজ। ভাই-দাদারা পাঞ্জাবি পরবে তো দিদি-বোনেরা শাড়ি। হিন্দু ধর্মের যে কোনও পুজো বা ব্রত সম্পন্ন হয় পরিবার, আত্মীয় স্বজনদের মঙ্গল কামনার উদ্দেশ্যে। ভাইফোঁটা হলো ভাই ও বোনের মঙ্গল কামনার ব্রত। উভয়ের জীবনেই যেন সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি বিরাজ করে, সেই প্রার্থনাই ভাই-বোনেরা একে অপরের উদ্দেশ্যে করে থাকে এই বিশেষ তিথিতে।
পঞ্জিকা অনুযায়ী, এই উৎসব কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়াতে উদযাপিত হয়। মাঝে মধ্যে এটি শুক্লপক্ষের প্রথম দিনেও উদযাপিত হয়ে থাকে। বাঙালির ঘরোয়া এই উৎসবে অন্যান্য পুজোর মতো রীতি, আচার বা মন্ত্রোচ্চারণ সেভাবে নেই বললেই চলে। ছড়ার মতো পাঠ করা হয়—
‘‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা—
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা॥’’
ভাইফোঁটা যেন বাঙালির নিজস্ব উৎসব। সবকিছুতেই বাঙালি মোড়ক। তবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভাইফোঁটার বিভিন্ন নাম রয়েছে। উত্তর ও পশ্চিম ভারতের এই উৎসব ‘ভাই দুজ’ নামে পরিচিত। সেখানে ভাইফোঁটা পাঁচ-দিনব্যাপী দীপাবলি উৎসবের শেষদিন। আবার, মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কর্ণাটকে ভাইফোঁটাকে বলে ‘ভাই বিজ’। নেপালে ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে এই উৎসব ‘ভাই টিকা’ নামে পরিচিত। ভাঁইফোটা, ভাই ও বোনদের উপহার পাওয়ার দিনও বটে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক প্রজন্মকে ভাইফোঁটার দিন ভাই ও বোনদের জন্য পছন্দ মতো 'গিফট আইটেম' কিনতে দেখা যায়। কোথাও কোথাও সামাজিক সদ্ভাবনার উদ্দেশ্যে গণ ভাইফোঁটার (Bhai Phonta) আয়োজন করা হয়।
এই পবিত্র দিনে বোনেরা ভাইয়ের কপালে চন্দনের ফোঁটা দেন। বাস্তুতন্ত্র অনুসারে ভাইকে ফোঁটা দেওযার সময় তাঁর মুখ পূর্ব, উত্তর বা উত্তর-পূর্ব দিকে থাকা উচিত। এই দিনে ভাইকে ফোঁটা দেওয়ার আগে কিছু খাওয়া উচিত নয়। ভাইয়ের থেকে পাওয়া উপহার যেমনই হোক না কেন, তার দেওয়া উপহারকে কখনও অসম্মান করবেন না। ভাইফোঁটার দিন কপালে ফোঁটা দেওযার আগে দুজনেই কিছু খাবেন না। ওই দিন মিথ্যা কথা একেবারেই বলবেন না। এদিন কালো কাপড় একেবারেই পরা উচিত নয়।
তবে, ভাইফোঁটার (Bhai Phonta) নেপথ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি পৌরাণিক কাহিনী। কথিত আছে, সূর্যদেব ও তার পত্নী সংজ্ঞার যমুনা নামে কন্যা এবং যম নামে পুত্রসন্তান ছিল। পুত্র-কন্যা সন্তানের জন্মের পরে সূর্যদেবের উত্তাপ স্ত্রী সংজ্ঞা সহ্য করতে পারতেন না। তিনি তখন নিজের প্রতিলিপি ছায়াকে স্বর্গলোকে রেখে মর্ত্যে নেমে আসেন। সংজ্ঞার প্রতিরূপ হওয়ার কারণে দেবতারা ছায়াকে চিনতে পারতেন না। স্বর্গে বিমাতা ছায়া যমুনা ও যমের প্রতি দুর্ব্যবহার করতে শুরু করেন। কিন্তু ছায়ার মোহে অন্ধ সূর্যদেব কোনও প্রতিবাদ না করায় অত্যাচারের মাত্রা দিনের পর দিন বাড়তেই থাকে। এভাবেই একদিন বিমাতা কর্তৃক স্বর্গরাজ্য থেকে বিতাড়িত হন যমুনা। যমুনার বিয়ে হয় এক উচ্চ বংশজাত পরিবারে। বিয়ের পর দীর্ঘকাল যমুনাকে দেখতে না পেয়ে মনে আকুলতা তৈরি হয় যমের। এরপরই মন শান্ত করতে দিদির বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন যম। কালী পুজোর দুদিন পরে যমুনার বাড়ি পৌঁছান যম। ভাইয়ের আগমনে তার জন্য জন্য নানা রকমের খাবারের আয়োজন করেন দিদি যমুনা। দিদির আন্তরিকতায় ও ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে দিদিকে উপহার স্বরূপ বরদান প্রার্থনা করতে বলেন যম। সেই সময় যমুনা ভাইয়ের কাছে প্রার্থনা করেন যে, ‘ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিন প্রত্যেক ভাই যেন তাঁর বোনের কথা স্মরণ করে এবং প্রত্যেক বোন যেন তাঁর ভাইয়ের মঙ্গলময় দীর্ঘজীবন কামনা করে।’ যমুনা আশীর্বাদ চাইলে যম বলেন যে, এই তিথিতে যে ভাই নিজের বোনের বাড়ি গিয়ে তাঁর পুজো স্বীকার করবে ও তাঁর হাতে তৈরি রান্না গ্রহণ করবে, তাঁর ভাগ্যে অকালমৃত্যুর ভয় থাকবে না। তখন থেকেই নাকি ভাইফোঁটার প্রচলন।
অন্য একটি পৌরাণিক মতে, নরকাসুর বধের পূর্বে সুভদ্রার কাছে আসেন শ্রী কৃষ্ণ। সুভদ্রা তখন শ্রী কৃষ্ণের মঙ্গল ও বিজয় কামনা করে কপালে ফোঁটা দিয়ে মিষ্টি খেতে দেন শ্রী কৃষ্ণকে। এরপরই নরকাসুরকে বধ করেন শ্রী কৃষ্ণ। আরও একটি কাহিনী মতে, বালির হাতে পাতালে বন্দি হন ভগবান বিষ্ণু। তখন মাতা লক্ষ্মী বালিকে ভাই হিসেবে স্বীকার করে তাঁর কপালে তিলক এঁকে দেন। বালি উপহার স্বরূপ মাতা লক্ষ্মীকে কিছু দিতে চাইলে, দেবী লক্ষ্মী ভগবান বিষ্ণুকে চেয়ে নেন। তখন থেকেই নাকি ভাঁইফোটা (Bhai Phonta) প্রচলিত।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook, Twitter এবং Google News পেজ।