ভক্তদের বিশ্বাস রয়েছে কল্যাণকারী মাতা তাঁদের জীবন থেকে সমস্ত পাপবোধ, ভয়, শত্রুতা, বাধা বিঘ্ন হরণ করে নেন।
মাতা চন্দ্রঘন্টা।
শুভ্র চট্টোপাধ্যায়: মহিষাসুর এর দখলে তখন সম্পূর্ণ স্বর্গ রাজ্য। দেবতা, মুনি, ঋষি কেউই রম্ভা পুত্রের ভয়ঙ্কর বীভৎস অত্যাচারে টিকতে পারছেন না। দেবতারা পরাস্ত এবং বিতাড়িত। ব্রহ্মার বরদানে মহিষাসুর কে প্রতিহত করার কেউ নেই। মহিষাসুর জানতো ব্রহ্মার আশীর্বাদে কোনো পুরুষ তাঁকে হত্যা করতে পারবে না। বিতাড়িত দেবতা , মুনি, ঋষিরা শরণাপন্ন হলেন ব্রহ্মা , বিষ্ণু, মহেশ্বর এর কাছে । মহিষাসুরের অত্যাচারের কাহিনী শোনার পর ক্রোধান্বিত হলেন ত্রিদেব অর্থাৎ ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর। ক্রোধাগ্নির প্রচন্ড তেজ সম্মিলিত হয়ে মহর্ষি কাত্যায়ন ঋষির আশ্রমে সৃষ্টি হলো এক নারীর। তিনি মা দুর্গা।
নবরাত্রির ন'দিনে মা দুর্গা নয়টি রূপ ধারণ করে অসুরদের সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ করেছিলেন। নবরাত্রির তৃতীয় দিনে পূজিতা হন মাতা চন্দ্রঘন্টা। পৌরাণিক সাহিত্যের ভাষায়-
পিণ্ডজপ্রবরারূঢা চন্দকোপাস্ত্রকৈর্য়ুতা ।
প্রসাদং তনুতে মহ্য়ং চন্দ্রঘণ্টেতি বিশ্রুতা ।।
প্রবল তেজ সম্পন্ন এই দেবী মাতা চন্দ্রঘন্টা , ঘন্টা বাজিয়ে অসুরদের সতর্ক করেন। এখনকার ভাষায় ওয়ার্নিঙ বলা যেতে পারে । তাই দেবীর নাম চন্দ্রঘন্টা। কালিকাপুরাণে দেবীর এমন নামকরণের উল্লেখ পাওয়া যায়। কাত্যায়ন মুনির আশ্রমে , ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের তেজ থেকে সৃষ্ট নারী মূর্তিকে যখন সমস্ত দেবতা একে একে অস্ত্র দ্বারা সজ্জিত করছিলেন তখন দেবতাদের রাজা ইন্দ্র “দদৌ তস্যৈ সহস্রাক্ষোঘণ্টাম ঐরাবতং গজাৎ” তাঁর বাহন ঐরাবৎ হাতির গলার ঘণ্টা থেকে একটি ঘণ্টা নিয়ে দেবীর একটি হাতে দিলেন।
আরও পড়ুন: নবরাত্রি কেন পালন করা হয়? এর তাৎপর্য জানেন?
যুদ্ধে ঘন্টা ধ্বনি, শঙ্খ ধ্বনির রীতি ছিল। কুরুক্ষেত্রের ময়দানেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পাঞ্চজন্য নামক শঙ্খ এবং অর্জুনকে দেবদত্ত নামক শঙ্খের প্রবল ধ্বনির দ্বারা বিপক্ষ শিবিরে ত্রাস সৃষ্টি করতে দেখা গেছে। যা গীতার প্রথম অধ্যায়ে উল্লেখিত রয়েছে।
পুরাণে উল্লেখ রয়েছে - অসুরদের সাথে প্রবল যুদ্ধ চলাকালীন মাতা চন্দ্রঘন্টার এই তীব্র ঘণ্টানাদ বিকট শব্দ সৃষ্টি করেছিল “হিরস্তি দৈত্য তেজাংসি স্বনেনাপূর্য্য যা জগৎ”। সেই ঘণ্টার শব্দেই দৈত্যদের প্রাণ ভয়ে খাঁচাছাড়া অবস্থা হয়েছিল। অসুরদের অশুভ শক্তি কে হরণ করার জন্যই মাতা চন্দ্রঘন্টা ঘন্টা বাজিয়েছিলেন। পৌরাণিক কাহিনী তে এও দেখা যাচ্ছে যে, যুদ্ধ শেষে মাতার এই ঘন্টার শরণাপন্ন হচ্ছেন দেবতা, মুনি, ঋষিরা। তাঁরা বলছেন - “সা ঘণ্টা পাতু নো দেবি পাপেভ্যো নঃ সুতাম্ইব ”। যার অর্থ বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়- " হে মা, তোমার এই প্রবল ঘন্টা ধ্বনি যেভাবে অসুরদের শক্তি ক্ষয় করে, তাদের দুর্বল করেছিল, ঠিক সেভাবেই এই ঘন্টা যেন আমাদের ভিতরে থাকা সমস্ত পাপবোধ কে হরণ করে নেয়"। ভক্তদের বিশ্বাস রয়েছে কল্যাণকারী মাতা তাঁদের জীবন থেকে সমস্ত পাপবোধ, ভয়, শত্রুতা, বাধা বিঘ্ন হরণ করে নেন।
আরও পড়ুন: মহালয়া শুভ না অশুভ? জানুন এই বিশেষ অমাবস্যা তিথির তাৎপর্য
পৌরাণিক কাহিনী তে আরও উল্লেখ রয়েছে -
দেবী চন্দ্রঘন্টা আসলে হিমালয় কন্যা ও শিবের স্ত্রী মাতা পার্বতী। শিব পার্বতীর বিবাহ পন্ড করতে তারকাসুর দৈত্য, দানবদের মিলিত এক বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করে। এই অবস্থায় বিবাহকে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে দেবী পার্বতী, মাতা চন্দ্রঘন্টার রূপ ধারণ করেন। তিনি ছিলেন বাঘের পিঠে সওয়ার । চন্দ্রের মতো বিশালাকার ঘন্টা তিনি বাজাতে থাকেন। ঘন্টার তীব্র আওয়াজে ভীতগ্রস্ত হয়ে দানবরা রণেভঙ্গ দেয়। একটি পৌরাণিক মত অনুযায়ী - দেবী পার্বতী এক্ষেত্রে কোনো উগ্র ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেননি।কারণ জন্মের পর যখন দশম মহাবিদ্যা ও বিশ্বরূপ দেবী পার্বতী তাঁর পিতা এবং মাতাকে দর্শন করিয়েছিলেন তখন দেবী পার্বতীকে তাঁর মাতা মেনকা প্রতিশ্রুতি বদ্ধ বা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করিয়ে নিয়েছিলেন যে যখন দেবী পার্বতী নিজ পিতৃগৃহে অবস্থান করবে তখন কোনো অবস্থাতেই তিনি উগ্র রূপ ধারণ করবেন না এবং তৃতীয় চক্ষুকে লুকিয়ে রাখবেন। অর্থাৎ মাতা পার্বতী পিতৃগৃহে থাকলে শান্ত হিমালয় কন্যা হিসাবেই থাকবেন।
অন্য একটি পৌরাণিক মত অনুযায়ী , শিব পার্বতীর বিবাহ কালে , শিব চন্ড এবং উগ্র মূর্তি ধারণ করলে , পার্বতীর মাতা মেনকা মূর্ছা যান। তখন পাল্টা হিসেবে দেবী পার্বতী মাতা চন্দ্রঘন্টার রূপ ধারণ করলে শিব শান্ত হন।
আরও পড়ুন: মেয়েরাও কি করতে পারে তর্পণ? কী বলছে শাস্ত্র?
শিবপুরাণ অনুযায়ী - চন্দ্রের শোভায় মুগ্ধ হয়ে শিব "চন্দ্র" কে নিজ মাথায় স্থাপন করেন। তাই তিনি চন্দ্রশেখর। শিবের এইরকম সাজ দেখে মাতা পার্বতী চন্দ্রঘন্টা রূপ ধারণ করেন। তাই মাতা চন্দ্রঘন্টা লাবণ্যময়ী। তাঁর হাত বিভিন্ন অস্ত্র দ্বারা সাজানো রয়েছে। যেমন - ত্রিশূল, গদা, তলোয়ার,তীর, ধনুক। এছাড়াও তাঁর হাতে রয়েছে পদ্মফুল ও মন্ডল। মাতা চন্দ্রঘন্টার একটি হাত সর্বদাই বরদা মুদ্রায় থাকে । যে মুদ্রায় তিনি তাঁর ভক্তদের সর্বদাই আশীর্বাদ করেন, তাঁদের নৈরাশ্য দূরীভূত করেন বলেই ভক্তদের বিশ্বাস রয়েছে। কল্যাণ প্রদান কারী মাতা চন্দ্রঘন্টার বাহন বাঘ অথবা সিংহ। তিনি ত্রিনয়নী এবং কপালে ঘন্টার আকৃতির অর্ধচন্দ্রের অবস্থান। মাতা চন্দ্রঘন্টা আসুরিক শক্তিকে ধ্বংস করতে বা বিনাশ করতে সদা প্রস্তুত। তাঁর ভক্তদের বিশ্বাস মাতা চন্দ্রঘন্টা জীবনের সকল বাধাবিঘ্ন দূর করে চলার পথকে সুগম করে তোলেন। এই দেবীর পছন্দের রঙ কমলা বলেই মনে করেন ভক্তরা , তাই এই নির্দিষ্ট রঙের পোশাক পরিধান করে মাতা চন্দ্রঘন্টার আরাধনা করলে সুফল বা শুভফল মেলে বলে ভক্তদের ধারণা। মাতার উদ্দেশ্যে তাঁর ভক্তরা সাধারণত দুগ্ধ জাত ভোগ নিবেদন করেন মায়ের নৈবেদ্য তে, এটা সাধারণত মিষ্টি, ক্ষীর বা রাবড়ি হয়। ভক্তদের বিশ্বাস এতে মাতা চন্দ্রঘন্টা প্রসন্ন হন।