গৌরী সেনের নাম শুনেছেন, কোথায় বাড়ি, কেনই বা তিনি মিথ হয়ে উঠেছেন, জানেন কি ?
কাল্পনিক গৌরী সেন (ফাইল ছবি)
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন। এই কথাটা আম বাঙালির কাছে বহুদিন আগেই প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছে। এখন মনে হতেই পারে, আদৌ কি গৌরী সেন (Gouri Sen) বলে কেউ ছিলেন, না নিছক কাল্পনিক একটি নাম। আর যদি সত্যিই গৌরী সেন বলে কেউ থাকেন, তাহলে তাঁর বাড়ি কোথায়? তিনি বিপুল অর্থের অধিকারীই বা কী করে হলেন। আর তিনি কী এমন করেছিলেন যার জন্য তিনি এখনও মিথ হয়ে রয়েছেন। এসব প্রশ্ন সকলের মনেই ঘুরপাক খাওয়াটাই স্বাভাবিক। গৌরী সেনকে নিয়ে অজানা সেই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি আমরা।
হুগলির সপ্তগ্রাম ছিল সেই সময় খুব সমৃদ্ধ নগর। প্রচুর বিত্তশালী মানুষের বসবাস ছিল। সেই সপ্তগ্রামেই গৌরী সেনের (Gouri Sen) পূর্ব পুরুষ অনিরুদ্ধ সেন বাস করতেন। পরবর্তীকালে কালের নিয়মে সরস্বতী নদী জৌলুস হারাতেই সপ্তগ্রামের গুরুত্ব কমতে শুরু করে। সরস্বতীর পরিবর্তে ভাগীরথী নদীতে রমরমিয়ে ব্যবসা শুরু হয়। হুগলিতে রাজকীয় বন্দর গড়ে ওঠে। ভাগীরথী নদীর মাধ্যমে চলে ব্যবসা বাণিজ্য। ভাগীরথী নদী তখন থেকে এই এলাকায় হুগলি নদী হিসেবে পরিচিত লাভ করে। সেই হুগলির বালিতে অনিরুদ্ধ সেন তাঁর দুই পুত্র নন্দরাম এবং পরাণচন্দ্রকে নিয়ে বসবাস শুরু করেন। নন্দরামের সাত সন্তান ছিল। তারমধ্যে গৌরীশঙ্কর ছিল সব থেকে ছোট। ১৬৪৮ সালে গৌরীশঙ্কর সেন (Gouri Sen) জন্মগ্রহণ করেন। এই গৌরীশঙ্করই পরবর্তীকালে দানবীর গৌরী সেন হিসেবে সুবে বাংলায় নাম করেন।
গৌরী সেনের (Gouri Sen) পূর্ব পুরুষ হলধর সেন ছিলেন খুব প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তবে, তা ছিল সপ্তগ্রামে। হলধর সেনের বংশধর হিসেবে গৌরী সেনের বাবা নন্দরামের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না। ফলে, সামান্য পুঁজি নিয়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সে গৌরী সেন ব্যবসা শুরু করেন। সেই সময় কলকাতার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী বৈষ্ণবচরণ শেঠের সঙ্গে অংশীদারী ব্যবসা শুরু করেন তিনি। সেই সময় মোটা কাপড়, শস্য, তেল, রাংতার ভালো বাজার ছিল। বড়বাজার ছিল তাঁর ব্যবসার ক্ষেত্র। বিভিন্ন জায়গা থেকে শস্য নিয়ে গৌরী সেন চাহিদা মতো নৌকা করেই জলপথে বিভিন্ন জায়গায় তা রফতানি করতেন। তাঁর সততা ও বুদ্ধির জোরে ব্যবসায় খুব তাড়াতাড়ি তিনি শ্রীবৃদ্ধি করেন।
প্রতিটি মানুষের জীবনে একটি টার্নিং পয়েন্ট থাকে। গৌরী সেনের (Gouri Sen) কর্মজীবনে এটাই ছিল টার্নিং পয়েন্ট। তবে, কাহিনীটা অলৌকিক মনে হতে পারে। জনশ্রুতি থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়। ১৬ বছর বয়সে ব্যবসা শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যেই রফতানি কারবার তাঁর বেশ জমে ওঠে। ব্যবসার সূত্র ধরেই মেদিনীপুরে ভৈরবচন্দ্র নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে। সেই সময় রাংতার ব্যবসা রমরমিয়ে চলত। বন্ধুর চাহিদা মতো সাত নৌকা শুদ্ধ রাংতা মেদিনীপুরে ভৈরবের কাছে তিনি পাঠিয়ে দেন। পথে একজন সাধু তাঁর একটি নৌকায় তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন। সাধু একটি নৌকায় চেপে বসেন। মেদিনীপুর ঘাটে নৌকা লাগে। ভৈরবের কর্মচারী রাংতা নিয়ে যাওয়ার জন্য নৌকায় ওঠেন। কিন্তু, অলৌকিভাবে সেই রাংতা সবই রুপোয় পরিণত হয়। ভৈরবচন্দ্র ওই রুপো আত্মসাত্ না করেই ফের হুগলি ঘাটে তা পাঠিয়ে দেন। চন্দননগরে জলপথ প্রহরী সব নৌকা বাজেয়াপ্ত করেন। হাকিমের কাছে গৌরী সেনকে তলব করা হয়। তবে, হাকিম তাঁকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে বেকসুর খালাস করে দেন।
জনশ্রুতি রয়েছে, দেবাদিদেব মহাদেব সাধু বেশেই তাঁর নৌকায় চেপেছিলেন। রাংতা থেকে রুপোয় রুপান্তরিত হওয়া, হাকিমের বেকসুর খালাস করে দেওয়ার পিছনেও মহাদেব রয়েছেন। পরে, তাঁকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে রুপো ভর্তি নৌকা নেওয়ার কথা বলা হয়। একইসঙ্গে স্বপ্নাদেশে শিবের মন্দির প্রতিষ্ঠার তিনি নির্দেশ পান। সেই রুপো বিক্রি করে রাতারাতি প্রচুর টাকার মালিক হলেন তিনি। স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর তিনি বাড়িতে শিবের মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেন। বিপুল পরিমাণ অর্থের অধিকারী হয়ে তিনি সবসময় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। কারও অর্থের অভাবে বিয়ে হচ্ছে না, কেউ চিকিত্সা করাতে পারছেন না, তিনি ত্রাতা হয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়াতেন। অনেকে আবার মিথ্যা গরিবের কথা বলে তাঁর কাছ থেকে টাকা আদায় করে সেই টাকায় ফূর্তি করতেন। অনেকে তাঁকে বুঝে-শুনে অর্থ খরচ করার পরামর্শ দিতেন, তিনি তাঁদের বলেছিলেন, মহাদেবের কৃপায় আমি এই বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছি, এই অর্থের মালিক আমি নই, আমি ভান্ডারি মাত্র। তাই, যখন যার প্রয়োজন হবে তাঁকে আমি অর্থ দিয়ে সাহায্য করব। টাকার অভাবে কারও কোনও কাজ পড়ে থাকবে না। লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন। আমৃত্য সেই কথা তিনি রেখেছিলেন। তাঁর কাছে এসে কেউ খালি হাতে ফিরে যেতেন না।
গৌরী সেনের (Gouri Sen) মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের লোকজন রাস্তায় মোহর ছড়িয়ে তাঁকে গঙ্গায় নিয়ে যান। হুগলির বালির বাড়িতেই তাঁর শ্রাদ্ধ হয়। তাঁর দুই সন্তান হরেকৃষ্ণ ও মুরলীধর। গৌরী সেনের মৃত্যুর পর মুরলীধর হুগলির বালির বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন। আর হরেকৃষ্ণ বালির বাড়িতে রয়ে যান। হরেকৃষ্ণের দুই সন্তান ছিলেন বিশ্বেশ্বর ও ভীমচাঁদ। বিশ্বেশ্বরের পরিবারের লোকজন সকলেই কলকাতায় চলে যান। ভীমচাঁদ ও তাঁর উত্তরসূরীরা হুগলির বালির বাড়িতেই বসবাস করেন। কালের নিয়মে তাঁর বংশধরেরা আজ কোথায় তা জানা নেই। তবে, মানুষের জন্য কাজ করা গৌরী সেনের সেই কাজের মধ্যে দিয়ে তিনি এখনও আম বাঙালির কাছে অমর হয়ে রয়েছেন।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook, Twitter এবং Google News পেজ।