সপ্তসিন্ধু তীরে খ্রিস্টের জন্মের ২৫০০ বছর আগে বেদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এক সভ্যতা
প্রতীকী ছবি
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: সপ্তসিন্ধু তীরে খ্রিস্টের জন্মের ২৫০০ বছর আগে বেদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এক সভ্যতা। বিভিন্ন সাহিত্যে, নাটকে কণ্ব মুনির আশ্রমে শকুন্তলার বেড়ে ওঠার গল্পতো খুবই জনপ্রিয়। প্রাচীন বৈদিক সভ্যতার সামাজিক জীবন আমাদের সামনে এইভাবেই চিত্রায়িত হয়।
গৈরিক বসন পরিহিত গলায় রুদ্রাক্ষের মালা সমেত শ্বেত শুভ্র লম্বা দাড়ি, ঋষি শব্দ শুনলেই আমাদের মনে এমন এক পুরুষের চিত্র ভেসে ওঠে। ঋষি মানে মন্ত্রদ্রষ্টা। যাঁরা সংস্কার দান করেন। সংস্কৃতিকে ধারণ করে থাকবেন এবং জীবন বোধ সম্পর্কে শিক্ষা দেবেন। প্রত্যেক বৈদিক ঋষিই ছিলেন এক একজন মহান যোগী যাঁরা ঘন অরণ্যে অথবা পর্বতের গুহায় তপস্যা করতেন। সর্বোচ্চ এবং শাশ্বত সত্যকে জানার তপস্যা। তপস্যায় তাঁরা যে জ্ঞান উপলব্ধি করতেন , সেই জ্ঞানই পরবর্তীকালে বেদ এবং বিভিন্ন মন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত হত।
প্রাচীন ভারতীয় ঋষিরা মহাকাশ বিজ্ঞান এবং প্রকৃতি সম্পর্কেও অনেক যুক্তিনির্ভর তথ্য দিয়েছেন। যেগুলি বর্তমানে সময়োপযোগী বলে প্রমাণিত হয়েছে। এগুলি ছাড়াও চিকিৎসা বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, সাহিত্য, প্রযুক্তিবিদ্যা, শিল্পবিদ্যা, আধ্যাত্মিক বিদ্যা এসব বিষয়ের চর্চাও প্রাচীন ভারতীয় ঋষিদের মধ্যে ছিল বলে জানা যায়। শূন্যের আবিষ্কারক আর্যভট্ট, জ্যোতির্বিজ্ঞানী বরাহমিহির, চিকিৎসাশাস্ত্রে চরক, সুশ্রুত ইতিহাস প্রসিদ্ধ নাম।
বৈদিক সভ্যতায় যে সমস্ত বিষয় ঋষিরা চর্চা করতেন সেগুলিকে সাধারণত বলা হত আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান, এটাই সনাতন ধর্মের (Sanatan Dharma) মূল তত্ত্ব বলা যেতে পারে। ভারতীয় পরম্পরা এবং ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার যে ধারা, সেটিকে ভারতীয় মুনি ঋষিরাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহন করে গেছেন। প্রাচীন ভারতীয় ঋষিরা সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতেন। সংস্কৃত ছন্দের মাধুর্যে উচ্চারিত হত বৈদিক শ্লোক। সারা পৃথিবীতে যখন লিখিত শব্দ অজ্ঞাত ছিল তখন কিন্তু ভারতীয় মুনি ঋষিদের স্মৃতিশক্তির কারণেই ঋষিদের জ্ঞান এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মের মধ্যে প্রবাহিত হতো। একেই বলা হয় গুরু শিষ্য পরম্পরা।
আধুনিককালে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যা কিছু পড়ানো হয় প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক সভ্যতায় (Sanatan Dharma) এর থেকে কম কিছু পড়ানো হতো না। সে সময়ে চতুরাশ্রমের কথাতো আমরা সকলেই জানি। ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাস। ব্রহ্মচর্য পালনকালে শিষ্যরা গুরুগৃহে থেকে বিদ্যা আহরণ করতো। এই সময়ে শিষ্যকে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান দান করতেন গুরু। কোন কোন বিষয় তখন গুরুগৃহে পড়ানো হত গুরুকুলে, তার একটি তালিকা একনজরে দেখা যাক। প্রথমে জেনে নিই বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিষয়ে কী কী পড়ানো হত।
১) অগ্নিবিদ্যা (Metallurgy)
২) বায়ুবিদ্যা (aviation)
৩) জলবিদ্যা (Navigation)
৪) অন্তরীক্ষবিদ্যা (Space Science)
৫) পৃথিবীবিদ্যা (Environment and Ecology)
৬) সূর্যবিদ্যা (Solar System Studies)
৭) চন্দ্রলোক বিদ্যা (Lunar Studies)
৮) মেঘ বিদ্যা (Weather Forecast)
৯) পদার্থ-বিদ্যুৎবিদ্যা (Battery)
১০) সৌরশক্তি-বিদ্যা (Solar Energy)
১১) দিনরাত্রি-বিদ্যা (Day Night Studies)
১২) সৃষ্টিবিদ্যা (Space Research)
১৩) মহাকাশ বিজ্ঞান (Cosmic Science)
১৪) ভূগোলবিদ্যা (Geography)
১৫) কালবিদ্যা (Time)
১৬) ভূগর্ভ-বিদ্যা (Geology and Mining)
১৭) রত্ন এবং ধাতুবিদ্যা (Gemology and Metal)
১৮) আকর্ষণবিদ্যা (Gravity)
১৯) আলোকবিদ্যা (Optics)
২০) যোগাযোগ-বিদ্যা (Communication)
২১) বিমানবিদ্যা (Aviation)
২২) জলযান-বিদ্যা (Water Hydraulics Vessels)
২৩) অস্ত্রবিদ্যা (Arms and Ammunition)
২৪) জীবজন্তু বিজ্ঞান (Zoology Botany)
২৫) পদার্থবিদ্যা (Material science)
বাণিজ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় পড়ানোর রীতিও প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক সভ্যতায় (Sanatan Dharma) প্রচলিত ছিল। এরকম ৩৫ টি বিষয় প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক সভ্যতাতে পড়ানো হতো যেগুলি আমরা জানবো এবার এক নজরে।
১) বাণিজ্য (Commerce)
২) ভেষজ (Pharmacy)
৩) শল্যকর্ম বা চিকিৎসা (Diagonis and Surgery)
৪) কৃষি (Agriculture)
৫) পশুপালন (Animal Husbandry)
৬) পাখি পালন (Birdkeeping)
৭) পশু প্রশিক্ষণ (Animal Training)
৮) যান যন্ত্রকার (Mechanics)
৯) রথকার (Vehicle Designing)
১০) রত্নকার (James Designing)
১১) সুবর্ণকার (Jewellery Designing)
১২) বস্ত্রকার (Textile)
১৩) কুম্ভকার (Pottery)
১৪) লৌহকার (Metallurgy)
১৫) তক্ষক (Toxicology)
১৬) রঙ্গসাজ (Dying)
১৭) রজ্জুকর (Logistics)
১৮) বাস্তুকার (Architect)
১৯) পাকবিদ্যা (Cooking)
২০) সারথ্য (Driving)
২১) নদীজল প্রবন্ধক (Water Management)
২২) সুচিকার (Data Entry)
২৩) গোশালা (Animal Husbandry)
২৪) নদী জল প্রবন্ধক (Water Management)
২৫) বাগানপাল (Horticulture)
২৬) বনপাল (Forestry)
২৭) বদ্যি (Paramedical)
২৮) অর্থশাস্ত্র (Economics)
২৯) তর্কশাস্ত্র (Logic)
৩০) ন্যায়শাস্ত্র (Law)
৩১) নৌকাশাস্ত্র (Ship Building)
৩২) রসায়ন শাস্ত্র (Chemical Science)
৩৩) ব্রহ্মবিদ্যা (Cosmology)
৩৪) অথর্ববেদ (Atharvved)
৩৫) ব্যবচ্ছেদ (Postmortem)
বেদ এবং স্মৃতির ভাগ
প্রাচীন ভারতীয় পরম্পরায় (Sanatan Dharma) বৈদিক সাহিত্যের দুটি ভাগ ছিল। একটি শ্রুতি এবং অপরটি স্মৃতি। গুরুর মুখ থেকে শিষ্যরা শুনে শুনে বেদ মুখস্ত করতো তাই বেদের অপর নাম শ্রুতি এবং এই পরম্পরা এক প্রজন্ম থেকে অপর প্রজন্মে প্রবাহিত হত। শ্রুতির মধ্যে চারটি বেদ রয়েছে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ। প্রতিটি বেদ আবার কতগুলি ভাগে বিভক্ত যেমন বেদাঙ্গ, উপবেদ, সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ।
প্রতিটি বেদাঙ্গের আবার ছ'টি ভাগ রয়েছে যেমন ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, নিরুক্ত, শিক্ষা, ছন্দ ও কল্প। প্রতিটি উপবেদের আবার চারটি ভাগ রয়েছে অর্থভেদ, ধনুর্বেদ, গন্ধর্ববেদ এবং আয়ুর্বেদ।
স্মৃতির মধ্যে পড়ছে ১৮ টি পুরাণ, তন্ত্রবিদ্যা, শ্রীমদ্ভাগবত গীতা সমেত বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র-গুলি তার পাশাপাশি ঐতিহাসিক যে গ্রন্থ, মহাকাব্য রামায়ণ এবং মহাভারতও স্মৃতির মধ্যে পড়ছে।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook এবং Twitter পেজ।
Tags: