১৭৬৬ সালে কৃষ্ণনগরের রাজবাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা হয়।
জগদ্ধাত্রী পুজো।
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: কালীপুজো, ভাইফোঁটার পরে এবার জগদ্ধাত্রী পুজো। জগদ্ধাত্রী পুজোকে ঘিরে উৎসব মুখর বাঙালির নজর এবং গন্তব্য থাকে দুটি জায়গায় একটি কৃষ্ণনগর এবং অপরটি চন্দননগর। রাজনৈতিক দলগুলির সমাবেশ 'ব্রিগেড চলো', 'কলকাতা চলো' ইত্যাদি নামে পরিচিত। জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন কোনও রাজনৈতিক দল ডাক না দিলেও 'কৃষ্ণনগর চলো' এবং 'চন্দননগর চলো' ডাকে সাড়া দিয়ে হাজির হয় রাজ্যের বড় অংশের মানুষ। সুসজ্জিত মন্ডপ, দূর্দান্ত আলোক সজ্জা, মাতা জগদ্ধাত্রীর প্রতিমা দেখতে লক্ষ মানুষের সমাগম হয় এই দুই শহরে। জমজমাট জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য ভারতীয় রেল বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করে। রাত বাড়লে মানুষের ঢল নামতে দেখা যায় দুই শহরে। কিন্তু জানেন কেন এই দুই শহরের জগদ্ধাত্রী পুজো এত জনপ্রিয় হলো? এর নেপথ্যে ইতিহাস কী? কারা শুরু করেছিল এই পুজো?
উত্তর জানতে আমাদের যেতে হবে নবাব আলিবর্দী খাঁ-এর আমলে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের উপরে ১২ লক্ষ টাকা নজরানা দাবি করেন নবাব। কৃষ্ণচন্দ্র রায় দিতে অপারগ হলে, তাঁকে বন্দি করে নবাবের বাহিনী। মুর্শিদাবাদ অথবা বিহারের মুঙ্গেরে রাজাকে রাখা হয়। মুক্তির পর নদীপথে নিজের রাজ্যে ফিরছিলেন রাজা, এমন সময় বিজয়া দশমীর প্রতিমা নিরঞ্জনের বাজনা শুনে তাঁর অন্তরে আকুলতা তৈরি হয়। দুর্গাপুজোয় অংশ না নিতে পারার আকুলতা। প্রাসাদে ফিরে রাজা মনের দুঃখে ঘুমোতে যান। কথিত আছে, ওই রাতে মাতা দুর্গা রাজাকে স্বপ্ন দেন, যে শুক্লা নবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রী রূপে তাঁকে পুজো করতে হবে। তখন থেকেই নাকি কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা।
আরও পড়ুন: কার্তিক মাসে গ্রাম বাংলায় পালিত হয় 'যমপুকুর ব্রত'! জানেন এর নেপথ্য গল্প?
অন্য একটি মতে, ১৭৬৬ সালে কৃষ্ণনগরের রাজবাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা হয়। আবার অনেকে কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র গিরিশচন্দ্রকে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবর্তক মনে করেন। কৃষ্ণনগরের প্রাচীন জগদ্ধাত্রী পুজোগুলোর মধ্যে চাষা পাড়াতে বুড়িমার পুজো অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। ৭৫০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার দ্বারা মাতা জগদ্ধাত্রীকে সাজানো হয় এখানে। এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রত বলে এলাকার মানুষ মনে করেন এবং দেবী তাঁর ভক্তদের সমস্ত মনস্কামনাও পূর্ণ করেন বলেই বিশ্বাস। এই পুজো শুরু হয় ১৭৯০ সালে। জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দরজা খুলে রাখার রীতি আজও চোখে পড়ে। তৎকালীন কৃষ্ণনগরের রানিমা রাজবাড়িতে বসেই প্রতিমা দর্শন করতেন। নিরঞ্জনের পূর্বে প্রতিমা রাজবাড়ির সামনে থেকে একবার ঘুরিয়ে আনতে হয়, এটাই এখানকার রীতি।
অন্যদিকে ফরাসি ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল চন্দননগর। এখানকার জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা করেন ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন ইন্দ্রনারায়ণ। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন চন্দননগরের ফরাসি সরকারের দেওয়ান। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পুজো দেখে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্রনারায়ণ চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেন। তাঁর প্রচলিত পুজো চন্দননগরে আদি পুজো নামে বিখ্যাত। জনশ্রুতি আছে, আদি প্রতিমাকে জলে নিরঞ্জন করা মাত্রই শুশুক বা সাপের দেখা পাওয়া যায়। স্থানীয় বিশ্বাসে এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রত এবং ভক্তদের সকল মনস্কামনা পূর্ণ করেন।
সারা রাজ্যের মানুষ তো এই দুই শহরে ভিড় করেই জগদ্ধাত্রী উপাসনায়। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের আবেগ যেন আলাদাই থাকে। কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা , কর্মসুত্রে হায়দরাবাদে থাকেন প্রিয়াঙ্কা ঘোষাল। জগদ্ধাত্রী পুজো দেখতে বাড়ি এসেছেন। তাঁর মতে, "দুর্গাপুজোর উন্মাদনা তো আমাদের আছেই, তার সঙ্গে আমরা সারাবছর অপেক্ষা করে থাকি এই জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্যও। দুর্গা পুজোর দশমীতে অতটাও মন খারাপ করে না, কারণ জানি, মাতা দুর্গা জগদ্ধাত্রী রূপে আবার আসছেন।"