জামাইষষ্ঠী মূলত লোকায়ত প্রথা। ষষ্ঠীদেবীর পার্বণ থেকেই এই প্রথার উদ্ভব। প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের ষষ্ঠী তিথিতে প্রথম প্রহরে ষষ্ঠীদেবীর পুজোর আয়োজন করা হয়...
জামাই ষষ্ঠী পুজোর আচার।
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। প্রতি মাসেই কোনও না কোনও উৎসব পালন করা হয়। নববর্ষ, অক্ষয় তৃতীয়ার পরই আসে জামাইষষ্ঠী। প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষে ষষ্ঠী তিথিতে জামাইষষ্ঠী পালন করা হয়। এবছর ৫ জুন, রবিবার ঘরে ঘরে পালিত হবে জামাইষষ্ঠী। ব্যস্ত সময়ে আদরের জামাইকে নিজে হাতে পঞ্চব্যঞ্জন রেঁধে খাওয়ানোর সুযোগ খুব কমই পান শাশুড়ি মায়েরা। এবছর রবিবার, ছুটির দিন তাই এমন সুযোগ কোনও ভাবেই হাতছাড়া করতে চান না অনেকে। তবে জামাইষষ্ঠী নাম হলেও আদতে মেয়ের মঙ্গল কামনাতেই এই উসৎব পালন করা হয়। এর পিছনে রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস।
ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এক সময়ে সংস্কার ছিল যে মেয়ের বিয়ের পর তার বাবা বা মা-মেয়ের বাড়িতে ততদিন পর্যন্ত যেতে পারবেন না, যত দিন না তিনি সন্তানের জন্ম দেন। এতে সমস্যা হল — সন্তানধারণে সমস্যা বা সন্তান মৃত্যুর (শিশুমৃত্যু) ফলে কন্যার পিতামাতাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হত কন্যার বাড়ি যাওয়ার জন্য৷ তাই উপায়? সমাজের বিধানদাতা জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা ষষ্ঠীকে বেছে নিলেন জামাইষষ্ঠী হিসাবে৷ যেখানে মেয়ে জামাইকে নিমন্ত্রণ করে সমাদর করা হবে ও কন্যার মুখ দর্শন করা যাবে৷ আর সেইসঙ্গে মা ষষ্ঠীর পুজো করে তাঁকে খুশি করতে হবে যাতে কন্যা শীঘ্র সন্তানের মুখ দর্শন করতে পারে ৷
ষষ্ঠী-পালন সাধারণত করে থাকেন মেয়েরা৷ তাঁদের কাছে এর তাৎপর্য অন্যরকম ৷ কথিত আছে — এক পরিবারে দুটি বউ ছিল৷ ছোট বউ ছিল খুব লোভী৷ বাড়ির মাছ বা অন্যান্য ভাল খাবার রান্না হলেই সে লুকিয়ে লুকিয়ে খেয়ে নিত আর শাশুড়ির কাছে অভিযোগ করত ‘সব কালো বেড়ালে খেয়ে নিয়েছে।’ বেড়াল মা ষষ্ঠীর বাহন ৷ তাই বেড়াল, মা ষষ্ঠীর কাছে অভিযোগ জানাল৷ মা ষষ্ঠী রেগে গেলেন৷ যার জেরে ছোট বউ-এর একটি করে সন্তান হয় আর মা ষষ্ঠী তার প্রাণ হরণ করেন৷ এইভাবে ছোট বউয়ের সাত পুত্র ও এক কন্যাকে মা ষষ্ঠী ফিরিয়ে নেন৷ ফলে স্বামী, শাশুড়ি ও অন্যান্যরা মিলে তাকে ‘অলক্ষণা’ বলে গালিগালাজ করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়৷ অথচ বড় বউ পুত্রকন্যাদের নিয়ে সুখে ঘর করতে থাকে৷
ছোট বউ মনের দুঃখে বনে চলে যান ও একাকী কাঁদতে থাকেন৷ শেষে মা ষষ্ঠী বৃদ্ধার ছদ্মবেশে তার কাছে এসে কান্নার কারণ জানতে চান৷ সে তার দুঃখের কথা বলে৷ তখন মা ষষ্ঠী তার পূর্বের অন্যায় আচরণের কথা বললে সে মাফ চায়৷ ষষ্ঠী তাকে ক্ষমা করেন। এরপর বলেন— ভক্তিভরে ষষ্ঠীর পুজো করলে সাতপুত্র ও এক কন্যার জীবন ফিরে পাবে৷ তখন ছোট বউ সংসারে ফিরে এসে ঘটা করে মা ষষ্ঠীর পুজো করে ও ক্রমে ক্রমে তার পুত্র কন্যাদের ফিরে পায়৷ এর থেকে দিকে দিকে ষষ্ঠী পুজোর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে৷ এটাই জামাই ষষ্ঠী বা অরণ্যষষ্ঠী ব্রতকথার মূল গল্প৷
জামাইষষ্ঠী মূলত লোকায়ত প্রথা। ষষ্ঠীদেবীর পার্বণ থেকেই এই প্রথার উদ্ভব। প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের ষষ্ঠী তিথিতে প্রথম প্রহরে ষষ্ঠীদেবীর পুজোর আয়োজন করা হয়। ষষ্ঠীদেবী মাতৃত্বের প্রতীক। জামাইষষ্ঠীর দিন জামাইয়ের হাতে হলুদ মাখানো সুতো বেঁধে দেওয়া হয় মা ষষ্ঠীর আর্শীবাদ রূপে। এরপর দীর্ঘায়ু কামনায় তেল-হলুদের ফোঁটা কপালে দিয়ে তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করা হয়। ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করা হয়। সঙ্গে একটি থালায় সাজিয়ে দেওয়া হয় পাঁচটি বিভিন্ন রকমের গোটা ফল আর মিষ্টি। এ তো গেল পুজোর রীতিনীতি।
জামাইষষ্ঠীর আসল চমক হল জামাইয়ের জন্য শাশুড়ি মায়ের নিজের হাতে রান্না করা পঞ্চব্যাঞ্জন। বিভিন্ন ধরনের মাছ, মাংস, মিষ্টির এলাহি আয়োজন। এখন অবশ্য উপহার দেওয়া-নেওয়ারও একটা পর্ব থাকে। নিয়মকানুন, রীতিনীতি, খাওয়া-দাওয়া, উপহার আদান-প্রদানের ভিড়ে এই উৎসবে মিশে থাকে সারা বছর ব্যস্ততার কারণে মেয়ে জামাইকে কাছে না পাওয়া মায়ের আবেগও। জামাইও শ্বশুরবাড়ি ঢোকার সময় দই-মিষ্টি আনতে ভোলেন না। প্রণামী হিসেবে শাশুড়িকে বস্ত্রাদি দেওয়ার রীতিও রয়েছে। সাহিত্যে এদিনে শ্যালক-শ্যালিকা নিয়ে জামাইয়ের থিয়েটার দেখা, সন্ধেবেলা জামাই ঠকানোর রঙ্গতামাশার কথাও আছে।