ঐতিহ্য মেনেই জাঁকজমকভাবে হয়ে আসছে মুর্শিদাবাদের বাজারসৌ ঘোষালবাড়ির কালীপুজো
বাজারসৌ ঘোষালবাড়ির কালী প্রতিমা। নিজস্ব চিত্র
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: খড়ের ছাউনি, মাটির দেওয়াল। একচালা মন্দিরের মধ্যে অষ্টধাতুর কালী বিগ্রহ। মন্দিরে নিত্যপুজো হত। কার্তিক মাসে কৃষ্ণপক্ষে বিশেষ দিনে ধুমধাম করে কালীপুজো হত। গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা সেই পুজোয় সামিল হতেন। তখন মুঘল যুগ। আর গৌড়ের শাসক সুলায়মান খান কররানি। তাঁর আমলে সেনাপতি ছিলেন কালাপাহাড়। সুবে বাংলা, ওড়িশা জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কালাপাহাড়। জগন্নাথ মন্দিরে হামলা চালিয়ে লুটতরাজ চালায় কালাপাহাড়। বাংলার একাধিক মন্দিরে হানা দেয় কালাপাহাড়ের দলবল। চলে লুটপাট। অত্যাচার থেকে মন্দির রক্ষা করতে মুর্শিদাবাদের বাজারসৌ ঘোষালবাড়ির অষ্টধাতুর বিগ্রহ মাটির তলায় রেখে দেওয়া হয়। তারপর থেকেই ঘোষালবাড়ির কালী মায়ের মৃন্ময়ী রূপ। কালের নিয়মে ঘোষালবাড়ি এখন ঘোষালপাড়়ায় পরিণত হয়েছে। পুরানো ঐতিহ্য মেনেই কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের বিশেষ দিনে জাঁকজমকভাবে পুজো (Kali Puja 2023) হয়ে আসছে।
কালীপুজোর ইতিহাস
পুজোর ইতিহাস জানার আগে জানতে হবে ঘোষালদের আদি বাসস্থান। পরিবারের প্রবীণ সদস্য প্রয়াত চণ্ডীদাস ঘোষাল, সুর্নিমল ঘোষালের কাছে পাওয়া তথ্য অনুসারে, বাজারসৌ ঘোষালদের আদি ভিটে ছিল দক্ষিণেশ্বরের পাশে আড়িয়াদহে। সেখান থেকে আট পুরুষ আগে রাম যাদব ঘোষাল বাজারসৌ আসেন। কান্দীর জেমোর জমিদারের অধীনে ছিল এই এলাকা। ওই জমিদারদের আমলেই মোড়পতলার দুর্গামন্দির, দুটি শিব মন্দির, বর্তমান ঘোষালপাড়ার পাশে শিবপুকুর পাড়ে তিনটি শিব মন্দির নির্মিত হয়েছিল। আর মন্দিরের সেবাইত ছিলেন রামযাদব। শিবপুকুরের পাড়ে শিব মন্দিরের আশপাশে ছিল বসতভিটে। বসতভিটের কাছেই একচালার মন্দির তৈরি করে শুরু হয়েছিল কালীপুজো (Kali Puja 2023)। তবে, নির্দিষ্ট সময়কালের নথি আর নেই। ফলে, শিবমন্দিরের পাশাপাশি কালী মন্দিরে নিত্যপুজো হত। সেই সময় ঘোষালদের সঙ্গে বন্দ্যোপাধ্যায়, ভট্টাচার্য, আচার্য্যরা সামিল হতেন। সেই সময় এই পুজোকে ঘিরে গোটা গ্রামের মানুষের উন্মাদনা ছিল চোখে পড়ার মতো।
কালীপুজোর অনেক আগে থেকে চলত প্রস্তুতি। এখন ঘোষালপাড়ায় করুণাসিন্ধু, দ্বিজত্তোম, দিলীপ, ভাগবত, মধুসূদন, তপন, স্বপন, উত্তম, জয়ন্ত, আশিস, সঞ্জয়, সমর ঘোষালের মতো প্রবীণ সদস্যরা রয়েছেন। মায়ের প্রতিমা থেকে সাজ, ঢাক-ঢোল সব কিছুই নির্দিষ্ট পরিবার থেকে প্রতি বছর আসত। ঘোষাল পরিবারের প্রবীণ সদস্যরা বলেন, সালারের কাছে হলদে থেকে নাটাকুরু আসতেন ঢোল, বাঁশি বাজাতে। বাজারসৌ দাসপাড়া থেকে ঢাক আসত। সুকুলি দাস, কুশো দাসরা বাজাতে আসতেন। লোহাদহ থেকে ক্ষীর, ছানা, দুধ আসত। বিনিময়ে জমি দেওয়া ছিল। আর ভরতপুর থকে মালাকার পরিবারের সদস্যরা মাকে ডাকের সাজ পরাতেন। আমাদের পুজো শুরু হওয়ার পর তালডাঙা মায়ের পুজো শুরু হত। ১০৮টি বলি হত। মেষ, মোষ বলি হত। বিশালকার তশলা ছিল। বাপ ঠাকুরদার সময় থেকেই এই নিয়ম চলে আসে। সেই সময় পরিবারের সদস্যরা মায়ের পুজোর (Kali Puja 2023) পৌরোহিত্য করতেন। আদি বড়মায়ের নতুন মন্দির তৈরিতে সহদেব ঘোষালের অন্যতম ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। সেই নতুন মন্দির এখনও বর্তমান রয়েছে।
সালটা ১৯৬৬। পরিবারের এখন যারা প্রবীণ সদস্য, তাঁরা তখন ছোট। পুজো সংক্রান্ত বিষয়ে মতবিরোধের জেরে পুজো (Kali Puja 2023) ভাগ হয়ে যায়। শিবনারায়ণ ঘোষালের ফাঁকা জমিতে মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। গৌরী-কান্তি-অনিল তিন ভাই মিলে নতুন করে কালীপুজো শুরু করেন।২০১১ সালে নতুন করে মন্দির তৈরির কাজ শুরু হয়। মন্দির তৈরিতে সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়, করুণাসিন্ধু, উদয়, দ্বিজত্তোম, দিলীপ, প্রয়াত চণ্ডী ঘোষাল, সুভাষ ঘোষাল, সুর্নিমল ঘোষালদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। পরিবারের আত্মীয়রা নতুন মন্দির তৈরিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। নতুন মন্দিরে সেই ঐতিহ্য মেনেই পুজো হয়ে আসছে। পুজোর দিন পরিবারের অধিকাংশ সদস্যও সারাদিন উপোস করে থাকেন। বিকেলের পর থেকে রাত পর্যন্ত চলে ভোগ রান্না। দুটি কালী মন্দিরে এখনও বলিপ্রথা অব্যাহত। তবে, মোষ বলি বহু বছর আগেই উঠে গিয়েছে। এখন শুধু ঘোষাল পরিবারের সদস্যরা ছাগ বলি দেন।
ঘোষালবাড়ির বর্তমান প্রজন্মের বেশিরভাগই কর্মসংস্থানের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকেন। পুজোর কদিন সকলেরই বাড়ি ফিরে আসেন। পরিবারের আত্মীয়স্বজনরাও সকলেই পুজোর কদিন চলে আসেন। আগের দিন থেকেই ঘোষালপাড়াকে আলোয় সাজানো হয়। প্রতিটি বাড়িতে জ্বলে ওঠে টুনি। আগে ছাদের উপর বাঁশ বেঁধে নাইট ল্যাম্প লাগিয়ে রঙিন কাগজ দিয়ে ঘেরা দেওয়া হত। সমগ্র এই উদ্যোগটাকে বলা হত ফনাস। সেই সময় ঘোষালপাড়া জুড়ে ফনাস টাঙানোর রেওয়াজ ছিল। সুতলির দড়িতে রঙিন কাগজ লাগিয়ে গোটা রাস্তা সাজিয়ে তোলা হত। এখন সেই রীতি উঠে গিয়েছে। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত কালীপুজোর আগেরদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। এছাড়া অর্কেষ্টা, বাউল গান, সাঁওতালি নাচ, ম্যাজিক শো হত। করোনার পর এখন আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় না। তবে, পুজোর আগের দিন মণ্ডপে বসে সান্ধ্যকালীন আড্ডা কার্যত মিলন উত্সবে পরিণত হয়। পুজোর আগের দিন ঢাক-ঢোলের আওয়াজে মন্দির চত্বর মুখরিত হয়ে ওঠে। পুজোর দিন সন্ধ্যায় গোটা ঘোষালবাড়ির ছাদ মোমবাতি জ্বালিয়ে সাজানো হয়। দুই কালী মন্দিরের সামনে ঢাক-ঢোল, সাউন্ড বক্সের আওয়াজে আর ছাদে থরে থরে সাজানো মোমবাতির আলোর রোশনাইয়ে গোটা ঘোষালপাড়া গমগম করে। পরিবারের নবীন সদস্যরা বলেন, পুজোর সময় সারারাত ধরে চেয়ারে বসে পুজো দেখা, ভোরের দিকে মন্দিরে বসে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার আলাদা উন্মাদনা। পুজোর (Kali Puja 2023) পরদিন প্রত্যেকের বাড়িতে পাত পেড়ে খাওয়া-দাওয়া হয়। পুজোর কদিন কার্যত ঘোষালপাড়া আদতে একটি বৃহত্ ঘোষালবাড়ির আকার নেয়। গোটা পাড়া হয়ে ওঠে একটি পরিবার। আলোর উত্সবে আদিশক্তির আরাধনায় মেতে ওঠে সকলে।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook, Twitter এবং Google News পেজ।