ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তাঁর শিষ্যদের উদ্দেশে বলেছিলেন, "তোমাদের চৈতন্য হউক"
আজ কল্পতরু উৎসব (ফাইল ছবি)
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: নতুন বছরের পয়লা দিন বলে কথা। বাঙালি মেতেছে বর্ষবরণের আনন্দে। এ আর নতুন কী! তবে ফি বছর ১ জানুয়ারির গুরুত্ব বাঙালির কাছে অন্যভাবেও রয়েছে, এদিন কল্পতর উৎসব (Kalpataru Utsav)। এদিনই বিশ্ববন্দিত হিন্দু ধর্মের প্রচারক স্বামী বিবেকানন্দের গুরু, ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তাঁর শিষ্যদের উদ্দেশে বলেছিলেন, "তোমাদের চৈতন্য হউক"। সকাল থেকেই দক্ষিণেশ্বর মন্দির থেকে শুরু করে রাজ্যের সর্বত্র ভক্তরা পালন করছেন কল্পতরু দিবস। ভোর থেকেই ভক্তদের ঢল দক্ষিণেশ্বর-কাশীপুর উদ্যানবাটিতে। এই দিনটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের স্মৃতি। আজ থেকে ১৩৮ বছর আগে, ১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারি কল্পতরু রূপে ভক্তদের আশীর্বাদ করেছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ।
পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমার কামারপুকুর গ্রামে ১৮৩৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি এক দরিদ্র বৈষ্ণব ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং চন্দ্রমণি দেবীর সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। কথিত আছে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে গয়া তীর্থ ভ্রমণে গিয়ে ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়, গদাধর বিষ্ণুকে স্বপ্নে দর্শন করেন। তাই নিজের চতুর্থ সন্তানের নাম তিনি রাখলেন গদাধর চট্টোপাধ্যায়। দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে ১৮৫৫ সালে গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের কলকাতায় আগমন ঘটে। কারণ মাহিষ্য সমাজের জমিদার পত্নী রানি রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন। রানিমা প্রধান পুরোহিতের দায়িত্বভার অর্পণ করেছেন কামারপুকুরের রামকুমারের হাতে। তরুণ গদাধর দাদাকে পূজা-অর্চনাতে সাহায্য করবেন। ১ বছরের মধ্যে ছন্দপতন। আকস্মিকভাবেই ১৮৫৬ সালে মৃত্যু হল রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন গদাধর চট্টোপাধ্যায়।
দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের প্রধান পুরোহিতের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন তিনি। মন্দিরের ঠিক উত্তর-পশ্চিম কোনে তরুণ পুরোহিতের জন্য একটি ছোট্ট ঘর বরাদ্দ করা হল। শোনা যায় এরপরেই রানি রাসমনির জামাতা মথুরামোহন গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের নামকরণ রামকৃষ্ণ করেন, তবে এ নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে, কেউ কেউ বলেন যে তাঁর এই নামকরণ করেন ঠাকুরের অন্যতম গুরু তোতাপুরী। প্রথাগত শিক্ষা তাঁর কিছুই ছিল না সেভাবে। কিন্তু মুখে মুখে বলে দিতেন হিন্দু শাস্ত্রের সমস্ত গূঢ়তত্ত্ব, অতি সরলভাষায়, একেবারে গল্পের ছলে। এজন্য তাঁকে গল্পের রাজাও বলা হয়। পরবর্তীকালে তাঁর এই বাণী সংকলিত হয় কথামৃত নামক গ্রন্থে। এরমধ্যে ঠাকুরের (Kalpataru Utsav) বিবাহ সম্পন্ন হয় কামারপুকুরের তিন মাইল উত্তর-পশ্চিমে জয়রামবাটী গ্রামের রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কন্যা সারদাদেবীর সঙ্গে। সেটা ১৮৫৯ সালে। এতদিনে বঙ্গীয় শিক্ষিত সমাজ তাঁকে গুরুর আসনে বসিয়ে ফেলেছে। শিষ্য তালিকায় স্থান পেয়েছেন কেশব চন্দ্র সেন সমেত অন্যান্য গন্যমান্যরা।
শরীরে মারণ রোগ বাসা বাঁধলে, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের নির্দেশে তিনি নিজেকে গৃহবন্দি রাখেন প্রায় এক মাস। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি কাশীপুর উদ্যানবাটিতে উপস্থিত রয়েছেন প্রায় ৩০ জন মতো গৃহী ভক্ত। সকলে হাতে ফুল নিয়ে উপস্থিত। আজ ঠাকুরের দর্শন পাওয়া যাবে। ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিক দুপুর তিনটে। দোতলা ঘর থেকে তিনি নেমে এলেন বাগানে। পরনে সেই চিরাচরিত পোশাক। লাল পেড়ে ধুতি। উপস্থিত গৃহী ভক্তরা তাঁদের হাতে রাখা ফুল ঠাকুরের চরণে অঞ্জলি দিতে থাকেন। কথিত আছে, ঠাকুর তখন নাট্যকার গিরিশ ঘোষকে বলেন, "হ্যাঁ গো, তুমি যে আমার নামে এত কিছু চারিদিকে বলো, তো আমি আসলে কী?" গিরিশ ঘোষ উত্তর দিলেন, "তুমিই নররূপ ধারী পূর্ণব্রহ্ম ভগবান, আমার মত পাপী-তাপীদের মুক্তির জন্যই তোমার মর্ত্যে আগমন।" সবাই তখন ঠাকুরের চরণ স্পর্শ করল এবং ঠাকুর বললেন, "তোমাদের চৈতন্য হউক"।
এর জন্য অবশ্য আমাদের পুরাণে ফিরতে হবে। হরিবংশ ইত্যাদি পুরাণে ‘কল্পতরু’র উল্লেখ রয়েছে। দেবতা এবং অসুরদের মধ্যে সমুদ্র মন্থন হয়েছিল, পুরাণ অনুযায়ী সমুদ্র মন্থনকালে অমৃত, লক্ষ্মীদেবী, ঐরাবত ইত্যাদির সঙ্গে উঠে আসে একটি বৃক্ষ-ও। যাকে পারিজাত বৃক্ষ বলা হত। পরবর্তীতে দেবরাজ ইন্দ্রের বিখ্যাত নন্দনকাননের স্থান পায় এই পারিজাত বৃক্ষ এবং সেখান থেকে স্ত্রী সত্যভামার আবদারে শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবীতে নিয়ে আসেন এই বৃক্ষ। এই পারিজাত বৃক্ষকে-ই ‘কল্পতরু’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ সেই বৃক্ষ, যার কাছে যা চাওয়া হয় তাই পাওয়া যায়। কল্পতরু উৎসবের (Kalpataru Utsav) দিন ঠাকুরের ভক্তরা তাঁকে অবতার রূপে মেনে নেন। কথিত আছে, সেদিন উপস্থিত সমস্ত ভক্তের মনোবাঞ্ছা ঠাকুরের কৃপায় পূরণ হয়েছিল। ভক্তদের বিশ্বাস রয়েছে, এই দিন ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব সকলের মনের ইচ্ছা পূরণ করেন।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook এবং Twitter পেজ।