শুভ্র চট্টোপাধ্যায়: আশ্বিন এবং চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথি থেকে পরের ন'দিন অবধি মা দুর্গার নয়টি অবতারের পুজো নবরাত্রি (Navratri) নামে পরিচিত। আরও সরল ভাষায় বলতে গেলে শরৎকালের নবরাত্রি মহালয়ার (Mahalaya) পরদিন থেকে শুরু হয়। ন'দিন ধরে মা দুর্গার (Goddess Durga) ন'টি অবতারের পুজো দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ধুমধাম করে হয়। প্রসঙ্গত, শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বী নয়, শিখ এবং জৈন সম্প্রদায়ের মধ্যেও নবরাত্রি পালনের রীতি দেখা যায়।
আসুন এবার একনজরে দেখে নেওয়া যাক মা দুর্গার (Maa Durga) এই ন'টি অবতার কী কী—
'শ্রী বরাহপুরাণে' হরিহর ব্রহ্মা ঋষির দ্বারা রচিত , দেবী কবচে লেখা রয়েছে -
প্রথমং শৈলপুত্রী চ
দ্বিতীয়ম্ ব্রহ্মচারিণী ।
তৃতীয়ং চন্দ্রঘণ্টেতি কুষ্মাণ্ডেতি চতুর্থকম্ ।।
পঞ্চমং স্কন্দমাতেতি,
ষষ্ঠম্ কাত্যায়নীতি চ।
সপ্তমং কালরাত্রীতি মহাগৌরীতি চাষ্টমং।।
নবমং সিদ্ধিদাত্রী চ
নবদুর্গা প্রকীর্তিতাঃ ।।
মাতা শৈলপুত্রী: নবরাত্রির প্রথম দিনে মাতা শৈলপুত্রীর পুজো করা হয়। দেবীর নামের অর্থ "পাহাড়ের কন্যা"। তাঁর ভক্তদের বিশ্বাস-মাতা শৈলপুত্রীর আশীর্বাদ স্বরূপ সুস্থ, রোগমুক্ত জীবন পাওয়া যায়। মাতার নৈবেদ্যতে খাঁটি ঘি অর্পণ করা হয়। এই দেবীর আরাধনায় মূলাধার চক্র শুদ্ধ হয়।
মাতা ব্রহ্মচারিণী: নবরাত্রির দ্বিতীয় দিনে এই দেবীর পুজো হয়। ব্রহ্মচারিণী মাতাকে খুশি করতে ভক্তরা চিনি নিবেদন করে থাকেন। বিশ্বাস মতে, মাতা তাঁর ভক্তদের দীর্ঘায়ু প্রদান করেন। এই দেবীর উপাসনার দ্বারা সাধিস্তান চক্র শুদ্ধ হয় হয় বলে ভক্তরা মনে করে।
আরও পড়ুন: মহালয়া শুভ না অশুভ? জানুন এই বিশেষ অমাবস্যা তিথির তাৎপর্য
মাতা চন্দ্রঘন্টা: তৃতীয় দিনে মাতা চন্দ্রঘন্টার প্রতি ভক্তি নিবেদন করা হয়। এই দেবীর বাহন বাঘ। উগ্র মূর্তি এই দেবীকে ক্ষীর ভোগ অর্পণ করেন ভক্তরা। ভক্তদের বিশ্বাস, দেবী সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাশ করেন এবং যাবতীয় বাধা বিঘ্ন দূর করেন।
মাতা কুষ্মান্ডা: চতুর্থ দিনে মাতা কুষ্মান্ডার প্রতি ভক্তি নিবেদিত হয়। শাস্ত্র মতে, এই দেবী মহাবিশ্বের স্রষ্টা। তিনি তাঁর ভক্তদের জ্ঞানদানের দ্বারা বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটান এবং কর্মক্ষেত্রে জটিলতা দূর করেন। দেবীকে মালপোয়া ভোগ অর্পণ করা হয়।
মাতা স্কন্দমাতা: নবরাত্রির পঞ্চম দিনে মাতা স্কন্দমাতার আরাধনা করেন ভক্তরা। ভগবান কার্তিককে কোলে নিয়ে উপবিষ্ট এই দেবীর আশীর্বাদ পেতে ভক্তরা কলা নিবেদন করেন। দেবীর আশীর্বাদে ভক্তের জীবনে পরম সুখ ও শান্তি আসে বলে বিশ্বাস।
মাতা কাত্যায়নী: ঋষি কাত্যায়নের কন্যা, শক্তির প্রতীক তথা যোদ্ধা দেবী কাত্যায়নী মাতার পুজো নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে সম্পন্ন হয়। ভক্তদের তিনি শক্তি, ধর্ম ও জাগতিক সুখ প্রদান করেন বলে বিশ্বাস। তাঁকে ভক্তদের মধু নিবেদনের রীতি চালু রয়েছে।
মাতা কালরাত্রি: সপ্তমী পুজো হয় এই দেবীর। দেবী ত্রিশূলধারী। মাতা কালরাত্রির আশীর্বাদে জীবনের সমস্ত কুপ্রভাব বিনষ্ট হয় বলে ভক্তদের ধারণা। মাতাকে গুড় নিবেদন করা হয়।
আরও পড়ুন: মেয়েরাও কি করতে পারে তর্পণ? কী বলছে শাস্ত্র?
মাতা মহাগৌরী: উজ্জ্বল সৌন্দর্যের প্রতীক এই দেবী অষ্টমীতে ভক্তদের দ্বারা আরাধিত হন। মাতা মহাগৌরীর একহাতে ত্রিশূল ও অপর হাতে ডমরু থাকে। তাঁর নৈবেদ্যতে নারকেল রাখার রীতি রয়েছে। বিশ্বাস রয়েছে, মাতার আশীর্বাদ স্বরূপ ভক্তদের ভালো বিবাহ হয়।
মাতা সিদ্ধিদাত্রী: নবরাত্রির শেষদিনে পুজো হয় এই দেবীর। তিনি ভক্তদের জীবনে সমস্ত অশুভ প্রভাব বিনষ্ট করেন এবং সাফল্য আনেন বলে ভক্তদের ধারণা। মাতা সিদ্ধিদাত্রীকে ভক্তরা তিল নিবেদন করে থাকেন।
সংস্কৃত সাহিত্যের ব্যাকরণ আচার্য উপাধি প্রাপক তথা হিন্দু শাস্ত্র বিশেষজ্ঞ কাটোয়ার সৌমিক চট্টোপাধ্যায় প্রতিদিন নিয়মিত ভাবে নিজ গৃহে চণ্ডীপাঠ করেন। নবরাত্রি পালনের বিষয়ে তাঁর অভিমত - "দেবী মাহাত্ম্য পাঠের আগে দেবী কবচে পাঠ করা হয়। কবচ শব্দের অর্থ যা রক্ষা করে, এখানে দেবীর নয় অবতার, আট শক্তি সহ সর্ব রূপের বর্ণনা এবং অশুভ শক্তির প্রভাব থেকে ভক্তকে রক্ষা করার বিষয় রয়েছে।"
সৌমিকবাবুর আরও সংযোজন- পুরাণ মতে, মা দুর্গা নয়দিন যাবৎ অসুরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এবং নবমীর রাতে মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। মা দুর্গার প্রতি ভক্তি নিবেদনের জন্য ভক্তরা নবরাত্রিতে মায়ের ন'টি রূপের পুজো করেন। অপর একটি মত হলো - নারদের প্রস্তাবে, রাবণ বধের উদ্দেশ্যে রামচন্দ্র ন'দিন উপবাস রেখে ব্রত পালন করেন এবং ব্রত শেষে রাবণকে বধ করেন। তাই সাফল্যের জন্য নবরাত্রির উপবাস রীতি প্রচলিত আছে।
নবরাত্রি (Navratri 2022) দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন নামে পরিচিত রয়েছে। যেমন - নভরাত্রি, নঔরাত্রি, নবরাহত্রি, নবরাতম, নঔরাতম ইত্যাদি। আচার, অনুষ্ঠান, রীতি, প্রথা মেনে পালিত হওয়া নবরাত্রিতে ভক্তরা ন'দিন যাবৎ উপবাস রাখেন তার সঙ্গে ইন্দ্রিয় সংযমের বিধিও পালন করা হয়। এসময় তামসিক খাবার যথা মাছ, মাংস, ডিম ভক্তরা খান না। ক্ষৌরকর্ম করেন না, প্রত্যহ ভোরবেলায় উঠে স্নান করে দেবীকে ভক্তরা নৈবেদ্য নিবেদন করেন। সনাতন সংস্কৃতির ধারক, বাহক ও পালক হলো এই নবরাত্রি ব্রত।
+ There are no comments
Add yours