প্রাচীন ভারতের জগদ্দলা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানুন
জগদ্দলা মহাবিহার (সংগৃহীত ছবি)
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: জগদ্দলা মহাবিহারের (Jagaddala Mahavihara) ধ্বংসাবশেষ বর্তমান বাংলাদেশের উত্তরে অবস্থিত। এই ভৌগোলিক অঞ্চল প্রাচীনকালে বরেন্দ্রভূমি নামেই পরিচিত ছিল। জগদ্দলা মহাবিহার ছিল বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার ও বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র। ঐতিহাসিকদের মতে, এই মহাবিহারকে স্থাপন করেছিলেন পাল রাজবংশের রাজা রামপাল। ১০৮৪ খ্রিস্টাব্দে এই মহাবিহার প্রতিষ্ঠিত হয় বলে জানা যায়। ঐতিহাসিকদের মতে জগদ্দলা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে গ্রানাইট পাথর দিয়ে। সাধারণভাবে তৎকালীন সময়ে যেকোনও স্থাপত্য নির্মাণ করা হতো কালো ব্যাসল্ট পাথর এবং বেলে পাথর দিয়ে। কিন্তু গ্রানাইট ছিল বিরল এবং তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সেই গ্রানাইট জগদ্দলা মহাবিহারে ব্যবহার করা হয়েছিল। সন্ধ্যাকর নন্দীর রচিত রামচরিতে জগদ্দলা মহাবিহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। আমাদের প্রতিবেদনে জগদ্দলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য দিক নিয়ে আমরা আলোচনা করব।
জানা যায় নালন্দা এবং বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের পতনের পরে অনেক বৌদ্ধ পণ্ডিত জগদ্দলা বিশ্ববিদ্যালয়ের (Jagaddala Mahavihara) চলে আসেন এবং এখান থেকেই গবেষণা ও অধ্যাপনা চালাতে থাকেন। ১৯৯৯ সালে জগদ্দলা বিশ্ববিদ্যালয়কে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রস্তাব করা রাখা হয়েছিল। জানা যায়, বৌদ্ধ ধর্মের তিনটি ভাগ ছিল হীনযান, মহাযান এবং বজ্রযান। এর মধ্যে জগদ্দলা মহাবিহার ছিল বজ্রযান বৌদ্ধ কেন্দ্র।
- তিব্বতের বেশ কিছু বিখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত যেমন বিভূতি চন্দ্র, দানশীলা, মোক্ষকার গুপ্তা, শুভাকার গুপ্ত এই মঠে অধ্যাপনা করতেন।
- জানা যায়, পাঁচটি বিখ্যাত মহাবিহারের মধ্যে জগদ্দলা ছিল অন্যতম। বাকি চারটি মহাবিহার হল বিক্রমশীলা, নালন্দা, সোমপুরা ও ওদন্তপুরী।
- ঐতিহাসিকদের মতে, জগদ্দলাতে (Jagaddala Mahavihara) বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হতো যার মধ্যে অন্যতম ছিল সংস্কৃত সাহিত্য তথা বৌদ্ধ ধর্ম। জগদ্দলাতে সুভাষিতরত্নকোষ যা সাহিত্যের প্রাচীনতম সংকলনগুলির মধ্যে অন্যতম, তা পাওয়া গিয়েছে।
- এছাড়াও এখানে প্রচুর সংখ্যক তিব্বতীয় গ্রন্থ লেখা হয়েছিল বা সেগুলোকে প্রতিলিপি করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
- ১২০৭ খ্রিস্টাব্দে অন্যান্য বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মতো এটিও ধ্বংস করে মুসলিম আক্রমণকারীরা। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়।
জানা যায়, ১০৫ মিটার দীর্ঘ ও ৮৫ মিটার প্রস্থ মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ বাংলাদেশের পাহাড়পুরে আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে পোড়ামাটির ফলক, ইট, পেরেক ও দেবতাদের তিনটি পাথরের মূর্তি। এছাড়াও সেখানে মিলেছে আরও দেড়শটিরও বেশি বস্তু। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভাবে রয়েছে মাটির পাত্র, বাটি, পোশাক পরা পাথরের মূর্তি। এর পাশাপাশি বিষ্ণু মূর্তিও সেখান থেকে উদ্ধার হয়েছে। এই বিষ্ণু মূর্তিটি জগদ্দলা মহাবিহারের দক্ষিণ অংশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য বিষ্ণু মূর্তির সঙ্গে যেমন দেবী লক্ষ্মীর মূর্তি থাকে, এখানে সেইরকম কিছু মেলেনি।
জগদ্দলা মহাবিহার বিভিন্ন কারণেই বৌদ্ধ ধর্ম তথা প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এক অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে চলেছে। বৌদ্ধ শিক্ষা, বিভিন্ন ধর্মীয় সাহিত্যের ভাণ্ডার এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের অন্যতম আবাসস্থল ছিল এই মহাবিহার। নালন্দা এবং ওদন্তপুরীর মতই জগদ্দলা মহাবিহারেও উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অংশ থেকে পণ্ডিত এবং ছাত্ররা আসতেন। স্বাভাবিকভাবেই বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন তত্ত্ব বহির্বিশ্বের সঙ্গে আদান-প্রদানের এক উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল এই মহাবিহার। বলা যেতে পারে তা বহির্বিশ্বের সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির এক সেতুবন্ধনের কাজও করত। জগদ্দলা মহাবিহার থেকে পাওয়া শিক্ষা নিয়ে ছাত্ররা তিব্বত সমেত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং তার বাইরেও বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার করতেন।
জানা যায়, জগদ্দলা মহাবিহারে (Jagaddala Mahavihara) অনেক প্রথিতযশা পণ্ডিত এবং শিক্ষকদের উপস্থিতিতে এক আদর্শ শিক্ষার পরিবেশ নির্মিত হয়েছিল। জগদ্দলার সঙ্গে যুক্ত বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পণ্ডিত রয়েছেন।
অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান: অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান একজন বিখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত এবং অধ্যাপক ছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, জীবনের একটি বড় অংশ তিনি জগদ্দলাতে কাটিয়েছেন। তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। জানা যায় বজ্রযান সম্প্রদায়ের প্রচার করতেন তিনি।
রত্নাকরসন্তি: রত্নাকরসন্তি একজন বিখ্যাত বৌদ্ধ দার্শনিক ছিলেন এবং তিনি জগদ্দলাতে শিক্ষকতা করতেন বলে জানা যায়। বিভিন্ন বৌদ্ধ গ্রন্থের উপরে তাঁর ভাষ্য ভারত ও তিব্বতে সমাদরে গৃহীত হয়েছে।
জ্ঞানশ্রীমিত্র: জ্ঞানশ্রীমিত্র একজন বিশিষ্ট শিক্ষক এবং দার্শনিক ছিলেন। তিনিও জগদ্দলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
প্রধান ভবন: জগদ্দলা মহাবিহারের কেন্দ্রস্থলে ছিল প্রধান ভবনটি। এটি ছিল অত্যন্ত প্রশস্ত। এখানে একাধিক হল, ধ্যানকক্ষ এবং শ্রেণিকক্ষ ছিল। অসংখ্য বৌদ্ধ ভিক্ষুক এবং ছাত্ররা এখানে গবেষণার কাজ করতেন।
প্রাঙ্গণ: জগদ্দলা মহাবিহার বাগান দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। একটি সুপ্রশস্ত প্রাজ্ঞণ ছিল এখানে। শান্তির পরিবেশ বিরাজ করত। বৌদ্ধ ভিক্ষুক এবং ছাত্ররা এখানে ধ্যান করতেন।
গ্রন্থাগার-অধ্যয়ন কক্ষ: প্রাচীন ভারতের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই জগদ্দলা মহাবিহারে একটি বড় গ্রন্থাগার ছিল। সেখানে বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের সংগ্রহ ছিল।
আবাসন: দেশ বিদেশ থেকে আগত ছাত্রদের এবং সন্ন্যাসীদের থাকার জন্য এখানে একটি আবাসনও গড়ে তোলা হয়েছিল
জগদ্দলা মহাবিহারের সন্ন্যাস জীবন, বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারে কঠোর অনুশাসন মেনেই চলত। আধ্যাত্মিক বিকাশের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হত। সন্ন্যাসী এবং ছাত্রদের অহিংসা পালন, ব্রহ্মচর্য ব্রত পালন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নৈতিক কর্তব্যবোধ -এ সমস্ত নিয়ম অনুসরণ করতে হতো। প্রতিদিন নিয়মিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র এবং শিক্ষকরা একসঙ্গে বসে ধ্যান করতেন বলে জানা যায়। এর পাশাপাশি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানেরও সেখানে আয়োজন করা হতো। সন্ন্যাসীরা আশেপাশের গ্রামে ভিক্ষা করতেন।
জানা যায়, প্রত্যেক সন্ন্যাসী এবং ছাত্রকে ভোরবেলায় উঠতে হতো এবং তারপরেই তাঁরা ধ্যান করতেন। এরপরেই সন্ন্যাসীরা বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ, দর্শন এবং যুক্তিবিদ্যার পাঠ ছাত্রদের দিতেন। মহাবিহারে দর্শন এবং বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ের উপর বক্তৃতা এবং বিতর্কের আয়োজন করা হতো। জগদ্দলা মহাবিহারে পণ্ডিতরা বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থ রচনার কাজেও নিযুক্ত ছিলেন। সারাদিন এভাবেই কাটতো। তারপরে প্রত্যহ সন্ধ্যায় জপ এবং অন্যান্য আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিন শেষ হতো।
মনে করা হয়, জগদ্দলা মহাবিহারের (Jagaddala Mahavihara) পতনের কারণের মধ্যে প্রধান কারণ ছিল মুসলিম আক্রমণ। সে সময়ে মুসলমান শাসকরা অন্য যেকোনও ধর্ম মতের বিরোধী ছিলেন এবং ইসলাম বিপন্ন হতে পারে এই আশঙ্কায় একাধিক বৌদ্ধ বিহারকে ধ্বংস করা হয়, গ্রন্থাগারগুলিকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। জগদ্দলাকেও ধ্বংস করে মুসলিম আক্রমণ। অন্যদিকে ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ক্রমশ কমতে থাকে। এর ফলে প্রাসঙ্গিকতা হারায় জগদ্দলা।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।