বড়লাটের ওপর বোমা নিক্ষেপ করে তাঁর সমর্থনেই সভা, জন্মদিনে জানুন রাসবিহারী বোসের রোমহর্ষক কর্মকাণ্ড
রাসবিহারী বোস (সংগৃহীত ছবি)
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: মহান বিপ্লবী রাসবিহারী বোসের জন্মদিন আজ। ১৮৮৬ সালের ২৫ মে বর্ধমান জেলার (বর্তমানে পূর্ব বর্ধমান) সুবলদহ গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। বিপ্লবী রাসবিহারী বোসের (Rash Behari Bose) রোমহর্ষক কর্মকাণ্ড, স্বদেশপ্রম, দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম তাঁকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। রাসবিহারী বোস স্থান পেয়েছেন সাহিত্যেও। অনেকের মতে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা 'পথের দাবী' উপন্যাসের সব্যসাচী চরিত্র যেন রাসবিহারী বোসের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।
আরও বিভিন্ন সাহিত্যে তুলে ধরা হয়েছে বিপ্লবীর (Rash Behari Bose) বীরত্ব গাধা। এমনই একটি বই হল - 'আমি রাসবিহারীকে দেখেছি', লেখক নারায়ণ সান্যাল। এই বইতে নারায়ণ সান্যাল লিখছেন, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে লোকটা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে, সঙ্গী আছেন নদীয়ার বসন্ত বিশ্বাস। হঠাৎই তিনি অল্পবয়সী সঙ্গীকে বললেন, ‘‘ভাল দেখে দুটো পাটনার টিকিট নিয়ে আয়।’’ লোকটাকে এর আগে দেখেনি বসন্ত বিশ্বাস! তারপর এই ধরনের কথাবার্তার জন্য ঠিকঠাক বনিবনাও হচ্ছিল না। সে বলল, ‘‘টিকিট আবার ভাল দেখে খারাপ দেখে হয় নাকি!!" আহ! কথা বাড়াস নি, টিকিট নিয়ে আয়। টিকিট এল পাটনার। লোকটি বসন্ত বিশ্বাসকে নিয়ে ছুটে গিয়ে উঠল দেরাদুন এক্সপ্রেসে। বসন্ত বিশ্বাস এবার নিশ্চিত হল লোকটা পাগল। ট্রেনে উঠেই বাথরুমে। বহুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে বললেন, ‘‘দেখিস নি একটা টিকটিকি আমাকে ফলো করছিল, বেচারা কাল সকালে পাটনায় নেমে আমাকে খুঁজবে, ভেরি প্যাথেটিক।’’ লেখকের আরও সংযোজন, ‘‘দিল্লির বুকে বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জের ওপর বোমা পড়ল। ওদিকে দেরাদুনে সন্ত্রাস বিরোধী সভা শুরু হল। সভাপতি রাসবিহারী বোস (Rash Behari Bose)। সেকি ভাষণ!! বন্ধু পুলিশ কী করছিল! গোয়েন্দারা এখন কোথায়!! এ যে ভারত আত্মার ওপর হামলা! সারা পৃথিবী আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। এমন ঘৃণ্য ঘটনা যারা ঘটায় তাদের দিল্লির চাঁদনি চকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া উচিত! পিছনের সারিতে বসে এই ভাষণ শুনছিল বসন্ত বিশ্বাস। সদ্য সে হার্ডিঞ্জকে বোমা মেরে এসেছে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না সে। এসব কথা কে বলছেন? যিনি নিজের হাতে আমাকে বোমা বানাতে শিখিয়েছিলেন! যিনি নিজে বোমা নিক্ষেপের সময় আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শ্রদ্ধায় ভক্তিতে মাথা নত হয় তার।’’
রাসবিহারী বোস (Rash Behari Bose) সম্পর্কে ওই বইতে আরও লেখা রয়েছে, সুনীল ঘোষ, দুঁদে গোয়েন্দা! স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন ‘‘ঘড়িয়ালটাকে আমি প্রচুর টাকা দিয়েছি, রাজভক্ত কর্মচারী হিসেবে বিপ্লবীদের ধরিয়ে দেওয়া নাকি তার কর্তব্য!! তাকে আমি এজেন্ট রেখেছিলাম ! আমার কাছে টাকা নিয়ে সে বিপ্লবীদের জন্য বোমা বানাতো।’’ সমগ্র ব্রিটিশ প্রশাসনকে চোখের জলে, নাকের জলে করে ছেড়েছিলেন। তিনিই ছিলেন একমাত্র বিপ্লবী যাঁকে শেষ দিন পর্যন্ত অতিসক্রিয় হয়েও ব্রিটিশ পুলিশ ধরতে পারেনি।
মাত্র তিন বছর বয়সেই রাসবিহারী বোসের মাতৃদেবী পরলোক গমন করেন এরপরে তিনি তাঁর মামার কাছে মানুষ হন। জানা যায় রাসবিহারী বসু প্রাথমিকভাবে তাঁর দাদু কালীচরণ বোসের তত্ত্বাবধানে সুবলদহে এবং পরবর্তীকালে চন্দননগরের ডুপ্লে কলেজে শিক্ষা লাভ করেন। তৎকালীন সময়ে সারা দেশে ব্রিটিশ শাসন থাকলেও চন্দননগর ফরাসি শাসনের অধীনে ছিল। বাল্যকালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা আনন্দমঠ উপন্যাস পড়ে তিনি অনুপ্রাণিত হন। তাঁর জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষণ ঘটে স্বামী বিবেকানন্দের বিভিন্ন লেখা এবং বক্তৃতা পড়ে। জানা যায়, বিপ্লবী তাঁর বাবার ইচ্ছায় সিমলা চলে যান এবং সেখানে সরকারী প্রেসে কাজ করতে থাকেন। এরপর সেখান থেকে এক সহকর্মীর পরামর্শে বিপ্লবী মহানায়ক প্রমথনাথ ঠাকুরের বাড়িতে দেহরাদুনে থাকতে শুরু করেন। সেখানে 'দেরাদুন ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউশন'-এ কেরানির চাকরি করতে থাকেন তিনি।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পরে বিভিন্ন বিপ্লবী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়তে থাকেন রাসবিহারী বসু (Rash Behari Bose)। তিনি ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের (বাঘা যতীন)। ১৯১২ সালে ২৩ ডিসেম্বর দিল্লিতে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের ওপর বোমা নিক্ষেপ করা হয়। যার মূল কারিগর ছিলেন রাসবিহারী বসু নিজে। সঙ্গী ছিলেন দুজন, বসন্ত বিশ্বাস ও অবোধ বিহারী বোস। দিল্লির শোভাযাত্রায় মহিলার বেশে বোমা ছোঁড়ার আগে বসন্ত বিশ্বাস প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন দেরাদুনে। প্রশিক্ষক ছিলেন রাসবিহারী বসু। টিনের সিগারেটের কৌটোতে পাথর ভরে, তা ছুড়তেন বসন্ত বিশ্বাস। ১৯১২ সালে ২৩ ডিসেম্বর বড়লাট হাতির পিঠে সওয়ার ছিলেন। সেসময় বোমা ছোড়া হয় তাঁর ওপরে। বোমার আঘাতে জখম বড়লাটকে ডাক্তার এসি সেনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। অবোধ বিহারী ও বসন্ত বিশ্বাস দুজনেরই ফাঁসি হয়। কিন্তু রাসবিহারী বোসকে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ পুলিশ ধরতে পারেনি।
বড়লাট মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেও রাসবিহারী বসুর বিপ্লবী প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। ১৯১৪ সাল নাগাদ, ভারতের বিপ্লবী কাজকর্মের জন্য আমেরিকা, কানাডা থেকে প্রচুর পরিমাণে বিস্ফোরক পদার্থ ভারতে আনা হয়েছিল। এই কাজগুলি করত মূলত আমেরিকার গদর পার্টি। এই সময়ে সামনে আসেন বিষ্ণু গনেশ পিংলার নাম। যিনি আমেরিকারতে একজন প্রশিক্ষিত গদর পার্টির নেতা। তিনি বারাণসীতে রাসবিহারী বোসের সঙ্গে দেখা করেন এবং এক বড় বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন। সেই মতো ১৯১৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীতে বিপ্লব করার দিনক্ষণ স্থির করা হয়। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী, সমস্ত পুলিশ ফাঁড়িগুলিকে দখল করে নেওয়া হবে, এমন পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু মাত্র ছয় দিন আগে ১৫ ফেব্রুয়ারি কৃপাল সিং এর বিশ্বাসঘাতকতায় এই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
এরপরেই ওই বছরেই অর্থাৎ ১৯১৫ সালের ১২ মে রাজ রাসবিহারী বসু ছদ্মবেশে কলকাতা ত্যাগ করেন। তিনি রাজা পিএন ঠাকুর হিসেবে জাপানে যান এবং নিজেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হিসেবে পরিচয় দেন। সে মতো পাসপোর্টও তিনি বানিয়েছিলেন। অনেক ঐতিহাসিক বলেন যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি অবগত ছিলেন রাসবিহারী বসুর এই ছদ্মবেশ সম্পর্কে। ১৯১৫ সালের ২২ মে সিঙ্গাপুরে এবং ওই বছরের জুন মাসে তিনি টোকিওতে পৌঁছান। ১৯১৫ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত রাসবিহারী বসু সতেরোবার তাঁর আবাসস্থল পরিবর্তন করেন বলে জানা যায়। পরবর্তীকালে তিনি বিয়ে করেন জাপানেই এবং সেখানকার নাগরিকত্ব নেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল তোসিকো। তাঁদের দুই সন্তান ছিল। একটি ছেলে এবং অপরটি মেয়ে। ছেলের নাম ছিল মাসাহিদ আর মেয়ের নাম ছিল তেতাকু।
১৯৪২ সালের ২৮ মার্চ টোকিও-তে একটি সম্মেলনের পরে তিনি 'ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ' কে প্রতিষ্ঠা করেন। এরপরেই সেই লীগের সভাপতি করার কথা ঘোষণা করেন সুভাষচন্দ্র বসুকে। জাপানিদের হাতে বন্দি ভারতীয় সেনাদের ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিতে যোগদান করানো হয়, যা আজাদ হিন্দ ফৌজ নামে পরিচিত। ১৯৪৫ সালের ২১ জানুয়ারি রাসবিহারী বসু (Rash Behari Bose), দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই টোকিওতে প্রয়াত হন। জাপান সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করে। 'দ্য সেকেন্ড অর্ডার অফ মেরিট অফ দ্য রাইসিং সান' সম্মান লাভ করেন তিনি।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।