প্রাচীন ভারতের বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন কোন বিষয় পড়ানো হতো জানেন?
প্রাচীন ভারতের বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় (সংগৃহীত ছবি)
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: পাল যুগের ভারতীয় উপমহাদেশে বৌদ্ধ শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র ছিল বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় (Vikramshila University)। ঐতিহাসিকদের মতে, রাজা ধর্মপাল যিনি ৭৮৩ থেকে ৮২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেছিলেন, তাঁর আমলেই অষ্টম শতাব্দীর শেষে তৈরি হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম অধ্যাপক ছিলেন প্রখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। বর্তমানে বিহারের ভাগলপুর শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের এই প্রতিবেদনে আমরা বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ইতিহাসকে তুলে ধরার চেষ্টা করব। তৎকালীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে প্রভাব তাও খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হবে এই প্রতিবেদনে। বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয় বরং জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার যে অনুশীলন তার একটি জীবন্ত উদাহরণ।
বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় (Vikramshila University) শুধুমাত্র একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠেনি বরং তা বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ের অধ্যয়ন, বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও বৌদ্ধ দর্শনের প্রচার কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন ভারতে অন্যতম শক্তিশালী জনপদ ছিল মগধ। সেই মগধ ছিল বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। অনেক বিখ্যাত পণ্ডিতই বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গঙ্গা নদীর ধারে অবস্থান হওয়ার জেরে, এই বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক এবং গবেষকদের নির্মল ও শান্ত পরিবেশ দিয়েছিল। যা গবেষণার কাজে অনুকূল। গঙ্গার তীরবর্তী হওয়ায় বাণিজ্য সমেত অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। গঙ্গা অববাহিকার এক অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ গড়ে উঠেছিল এবং সেখানে বাইরে থেকে ছাত্র ও পণ্ডিত এসে থাকতেন। নালন্দা এবং ওদন্তপুরীর মতোই বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল প্রাচীন ভারতের অন্যতম বিখ্যাত মহাবিহার। সে সময়কার রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞান শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়। বৌদ্ধ শিক্ষার ঐতিহ্যকে বহন করত এই প্রতিষ্ঠান। এখানে বৌদ্ধ দর্শন, তন্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ এবং অন্যান্য বেশ কিছু বিষয় পড়ানো হতো বলে জানা যায়। পৃথিবীব্যাপী বিখ্যাত অধ্যাপকদেরও আকৃষ্ট করেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়।
বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে (Vikramshila University) নানা বৈচিত্রধর্মী এবং বিভিন্ন কঠিন বিষয় পড়ানো হতো। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের চর্চার পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রদেরকে এখানে সুশৃংখল জীবন যাপন করতে হতো। এমনই তথ্য জানা যায় বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের গবেষণায়। এখানে যে সমস্ত বিষয়গুলি পড়ানো হতো তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য-
বৌদ্ধ দর্শন: বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে (Vikramshila University) বৌদ্ধ দর্শন পড়ানো হতো। এখানকার বৌদ্ধ দর্শনের ওপর নামকরা পণ্ডিতরা, ছাত্রদের ক্লাস নিতেন। দর্শনের বিভিন্ন স্কুল যেমন মধ্যমাকা, যোগাকারা প্রভৃতি বিষয় পড়ানো হতো বলে জানা যায়। এর পাশাপাশি বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা বিভিন্ন বিতর্কেও অংশগ্রহণ করতেন। তাঁদের ভেতরের জ্ঞান এবং উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পেত এর মাধ্যমে।
তন্ত্র: বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় (Vikramshila University) অন্যতম পাঠ্য বিষয় হিসেবে পড়ানো হতো তন্ত্র। বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন গুপ্ত এবং আধ্যাত্মিক দিকগুলির উপরে জোর দেওয়া হতো।
যুক্তিবিদ্যা: বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে (Vikramshila University) অন্যতম বিষয় হিসেবে পড়ানো হতো যুক্তিবিদ্যা। এই বিষয়টি পড়ুয়াদের মধ্যে চিন্তা ভাবনা করার দক্ষতাকে অনেকটাই বাড়াত।
ব্যাকরণ: জানা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম বিষয় হিসেবে ব্যাকরণও পড়ানো হতো। ছাত্রদের সংস্কৃত এবং পালি ভাষার ব্যাকরণের জটিল অধ্যায়গুলি এখানে শেখানো হতো বলে জানা যায়। প্রসঙ্গত, বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন দর্শন ও সাহিত্যের ব্যাখ্যা করার জন্য ব্যাকরণ পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল
বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচীন ভারতে একাধিক বিশিষ্ট পণ্ডিতদের গবেষণা ও পাঠদানের কেন্দ্র ছিল। এ সমস্ত শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষতা বাড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। আজকে আমাদের এই প্রতিবেদনে বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েকজন উল্লেখযোগ্য পণ্ডিতকে নিয়ে আলোচনা করব।
অতীশ দীপঙ্কর: বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের (Vikramshila University) সঙ্গে যুক্ত খ্যাতনামা পণ্ডিত ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। জানা যায়, তিনি ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষক এবং বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রও বটেন। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান নিজের জ্ঞান এবং চিন্তাভাবনা পরবর্তীকালে তিব্বতে ছড়িয়ে দেন এবং সেখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
বসুবন্ধু: বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম অধ্যাপক হিসেবে নাম উঠে আসে বসুবন্ধুর। তিনি ছিলেন একজন বৌদ্ধ দার্শনিক। বৌদ্ধ চিন্তার বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান তিনি রেখেছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর নানা রকমের গবেষণা, বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের পড়ানো হতো।
বিদ্যা কোকিলা: বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম খ্যাতনামা দার্শনিক ছিলেন বিদ্যা কোকিলা। ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি যুক্তিবিদ্যা এবং দর্শন এই দুই বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। তাঁর চিন্তা-ভাবনা এবং পাঠদান তৎকালীন বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বৌদ্ধ যুক্তিবিদ্যায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী।
জ্ঞানশ্রীমিত্র: জ্ঞানশ্রীমিত্র নামে অপর একজন উল্লেখযোগ্য শিক্ষকের কথা জানা যায়। ইনিও বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করতেন। তাঁর পাঠদানের পদ্ধতিতে ছাত্ররা মুগ্ধ হতেন বলে জানা যায়। তিনিও ছিলেন একজন বৌদ্ধ দার্শনিক।
শুধুমাত্র শিক্ষকদের অবদানের জন্যই বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের গরিমা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, এমনটা নয়। এখানকার পড়ুয়ারাও ছিলেন অসামান্য কৃতি এমনটাই জানা যায়, বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের গবেষণায়। বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখ যোগ্য ছাত্ররা হলেন-
অতীশা: আগেই বলা হয়েছে অতীশা বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন পরবর্তীকালে। বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্র তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার করেন।
নালন্দার ধর্মপাল: নালন্দার ধর্মপাল ছিলেন একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারকও বটেন। জানা যায়, তিনিও বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতেন। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্মের ঐতিহ্যকে বিভিন্ন জায়গায় তুলে ধরেন এই ছাত্র।
মৈত্রিপা: জানা যায় মৈত্রীপা নামের এই ছাত্র তন্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করতেন এবং তান্ত্রিক বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তিনিও ছিলেন একজন বৌদ্ধ পণ্ডিত।
এই সমস্ত অসামান্য পণ্ডিত এবং ছাত্রদের উপস্থিতিতে বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় উৎকর্ষতার এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায়, এর ফলে তৎকালীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধ শিক্ষা দর্শনের একটি সমৃদ্ধশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়।
বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় (Vikramshila University) শুধুমাত্র জ্ঞান সাধনার অন্যতম পীঠস্থান ছিলনা, বরং স্থাপত্যের জন্য়ও তা বিখ্যাত ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছিল বিভিন্ন লাইব্রেরী, যা অধ্যয়নের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছিল। বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম বই জাতকের কাহিনী, বিভিন্ন দেবতাদের জীবনের দৃশ্যগুলিও বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালে চিত্রিত করা হয়েছিল। যা এক নিপুণ শিল্পকর্মকে প্রতিফলিত করে। জানা যায়, বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৌদ্ধধর্ম ছাড়াও অন্যান্য ধর্মেরও গ্রন্থ সংরক্ষণ করা হতো। সেখানকার বিভিন্ন বইগুলিকে যত্ন সহকারে প্রতিলিপি করা হতো। অনেক বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থকে সংস্কৃত থেকে অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল বলে জানা যায়।
আরও পড়ুন: অক্সফোর্ড প্রতিষ্ঠার পাঁচশো বছরেরও আগে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি ছিল বিশ্বজুড়ে
বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের পতনের জন্য অনেক কারণকে সামনে আনা হয়। যার মধ্যে অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বারবার মুসলিম বাহিনীর আক্রমণ চলতে থাকে। যার ফলে পড়াশোনা ব্যাহত হয় এবং এর কাঠামো ধ্বংস হয়। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, পাল রাজবংশের পতনের পরে বিক্রমশিলার বিশ্ববিদ্যালয় আর কোনওরকম সেভাবে আর্থিক সহায়তা পায়নি, যার ফলে ক্রমশ তা পৃষ্ঠপোষকতা হারাতে থাকে। অনেক ঐতিহাসিক এও মনে করেন যে ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্ম প্রাধান্য হারাতে শুরু করলে বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব হ্রাস পেতে থাকে।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।