রাস পূর্ণিমার বিশেষ তিথিতে গোটা নবদ্বীপ শহর সেজে ওঠে আলোর মালায়। চোখে পড়ে মণ্ডপের কারুকার্য।
রাসযাত্রা।
শুভ্র চট্টোপাধ্যায়: ভারতবর্ষের মন্দির নগরী বলা হয়ে থাকে 'বারাণসী' কে। নবদ্বীপ ঘুরলে মনে হতেই পারে এ যেন বারাণসীর আরেকটি নতুন সংস্করণ। প্রাচীন বাংলার বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র ছিল নবদ্বীপ। প্রাচীন এই নগরীকে বলা হতো 'বাংলার অক্সফোর্ড'। বহুগুণী এবং পন্ডিত মানুষদের পান্ডিত্যে সমৃদ্ধ এই জনপদে জন্ম নিয়েছিলেন গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু। বাংলার সেন রাজাদের এই রাজধানী আক্রমণ করেন ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজী। লুন্ঠন, হত্যা ধর্মান্তরকরণের পরেও অক্ষত ছিল ঐতিহ্যবাহী এই নগরীর সাংস্কৃতিক পরিবেশ। হিন্দু ধর্মের শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈবদের পীঠস্থান বলুন বা তীর্থস্থান বলুন, সেটা নবদ্বীপ। পুণ্যতোয়া গঙ্গা নদীর স্রোতের ধ্বনি, বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণের রীতি দেখলে মনে হতেই পারে যেন ঋক বৈদিক যুগের কোনও নগরীতে আপনি উপস্থিত হয়েছেন।
নবদ্বীপের 'রাস' অতি জনপ্রিয়। রাস পূর্ণিমার বিশেষ তিথিতে গোটা নবদ্বীপ শহর সেজে ওঠে আলোর মালায়। চোখে পড়ে মণ্ডপের কারুকার্য। নবদ্বীপের এই রাস উৎসবকে কেন্দ্র করে অগণিত মানুষের সমাবেশ ঘটে। রাজ্য, দেশ ছাড়িয়ে বিদেশ থেকেও অনেক মানুষ রাস উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। জনশ্রুতি রয়েছে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নবদ্বীপে প্রথম রাসযাত্রার সূচনা করেন। বলা হয়ে থাকে 'রস' থেকে 'রাস' শব্দটি এসেছে। এর অর্থ আনন্দ বা দিব্য অনুভূতি। গোপিনীরা শ্রী কৃষ্ণের সাথে এই আনন্দ ভাগ করে নিতেন। পৌরাণিক এই ঘটনার স্মরণেই রাস যাত্রার উদ্ভব বলে বিশ্বাস রয়েছে। মূলত বৈষ্ণবীয় ভাবধারার এই রাস যাত্রা নবদ্বীপে আজ অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মৃত্যুর পর রাসযাত্রার ওপরে বৈষ্ণবীয় ভাবধারার প্রভাব ক্ষীণ হতে থাকে। সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে থাকে 'শাক্ত' ভাবধারা। তাই নবদ্বীপে বর্তমান যে রাসযাত্রা সেটার উপর শাক্ত ভাবধারার প্রভাব সব থেকে বেশি। মদ ,মাংস ,আড়ম্বর এগুলি হলো বীরাচার বা শাক্ত ভাবধারার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। নবদ্বীপের রাসযাত্রায় এগুলো বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়।
আরও পড়ুন: রাত পোহালেই জগদ্ধাত্রীর আরাধনায় মাতবে বাঙালি! জানেন কে এই পুজোর শুরু করেন?
জনশ্রুতি আছে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নবদ্বীপে শাক্ত রাসের প্রবর্তন করেন। একাধারে এই রাজার নামের সাথে বাংলায় প্রথম জগদ্ধাত্রী পূজার ইতিহাস যেমন সম্পর্কিত, একইভাবে রাসযাত্রার ইতিহাসও সম্পর্কিত। শক্তি, বীরাচার এবং রাজসিক গুণের আচরণ রাজা করবেন, একথাই তো স্বাভাবিক। মনে করা হয়, বৈষ্ণব ভাবধারার প্রভাব রাসযাত্রার উপর থেকে ক্ষীণ হতে শুরু করে যখন থেকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এখানে শাক্ত রাসের সূচনা করেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র গিরিশচন্দ্র পোড়ামাতলায় ভবতারণ শিব ও ভবতারিণী শক্তিমূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। কথিত আছে, রাসযাত্রায় তিনি নবদ্বীপের পণ্ডিতকে প্রচুর দানধ্যান করতেন। রাসযাত্রার প্রথমদিকে নবদ্বীপে শুধুই পটপুজো হতো। কথিত আছে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নাটোর থেকে মৃৎশিল্পী নিয়ে আসেন। তারপর থেকেই রাসযাত্রায় মূর্তিপূজা হতে থাকে।
গোবিন্দদাসের পদাবলীতে উল্লেখিত বৃন্দাবনে গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণ যখন রাসলীলায় মগ্ন, স্বর্গের দেবদেবীরা তখন তা দেখতে বৃন্দাবনে এসেছিলেন। ভক্তদের বিশ্বাস, রাসলীলা দেখার জন্য দেবদেবীরা এসেছিলেন নবদ্বীপেও। চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থানে রাস উপলক্ষে সাড়ে তিনশো দেবদেবীর পুজো হয়। পোড়ামাতলায় মহিষমর্দিনী মাতার পুজো হয়। রাসে কেবলমাত্র এই প্রতিমার পুজোই তিনদিন ব্যাপী দুর্গামন্ত্রে হয়। শতবর্ষ প্রাচীন ওলাদেবীতলার মুক্তকেশীর ভোগ দেওয়ার রীতি রয়েছে ইলিশমাছ সহযোগে। খড়েরগোলার বিন্ধ্যবাসিনী অষ্টভুজার আরাধনা বৈষ্ণব মতে হয়ে থাকে। নবদ্বীপের রাসে শাক্তমূর্তি বেশী দেখা যায়। দেবী কালিকা কত বিচিত্র নামে পূজিতা হন এই রাসযাত্রায়—বামকালী, নৃত্যকালী, উড়ন্তকালী, মুক্তকেশীকালী, মহানিশাকালী, তোতাপুরীকালী ইত্যাদি। সাধক রামপ্রসাদের কালী ভাবনার পূর্ণ প্রতিফলন দেখা যায় ‘শবশিবার’ রূপকল্পনায়। এখানে ভূমিতে পরে আছে শব তার উপরে শায়িত আছেন শিব এবং সর্বোপরি দেবী মহামায়ার অধিষ্ঠান। দেবীর পাদস্পর্শে শব রূপান্তরিত হয়েছে শিবে। বড় বড় প্রতিমাগুলি নবদ্বীপ শহর পরিক্রমণ করে। রাসযাত্রার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এটি। বিশালাকার গৌরাঙ্গি মাতার শোভাযাত্রা দেখতে গোটা নবদ্বীপ শহরে ভিড় উপচে পড়ে। রাসযাত্রার এই কয়েকটা দিনে হিন্দু ধর্মের প্রধান দেব-দেবীদের একসাথে পুজো নবদ্বীপ শহরেই দেখা যায়।