যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক ধারণা বেদে রয়েছে তারমধ্যে কিছু বৈজ্ঞানিক ধারণা সম্পর্কে আজকে আমরা জানব
প্রতীকী ছবি
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: বিখ্যাত ভারতীয় গণিতজ্ঞ শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার রামানুজন বলেছিলেন, "অঙ্কের সেই সূত্রটির কোনও গুরুত্ব আমার কাছে নেই যে সূত্রটি থেকে আমি আধ্যাত্মিক বিচার না পাই।" আগের পর্বে আমরা আলোচনা করেছি, এই আধ্যাত্মিক বিচারই হল বেদের ভিত্তি। বৈদিক সভ্যতায় (Vedic Civilization) ৬০টিরও বেশি বিষয় পড়ানো হত যেগুলো সম্পর্কে বিস্তৃত ব্যাখ্যা করা হয়েছে পূর্ববর্তী পর্বে। মহাকাশ বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা এসব কিছুই বৈদিক সভ্যতার (Vedic Civilization) পঠন-পাঠনের অন্যতম বিষয় ছিল। যুক্তিবাদী বৈদিক সভ্যতা সবকিছুকেই যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করেছে। ঋকবৈদিক যুগের বিভিন্ন শ্লোকে উল্লেখ রয়েছে আলোর গতিবেগ নির্ণয় সূত্র, মহাকর্ষ বল এবং অভিকর্ষ বল সম্পর্কে। অর্থাৎ স্যার আইজ্যাক নিউটনের আবিষ্কারের অনেক আগেই মহাকর্ষ বল সম্পর্কে বৈদিক ঋষিদের ধারণা ছিল একথা দৃঢ়ভাবে বলা যায়। ডালটনের পরমাণুবাদ সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণীর থেকেই পড়ানোর রীতি রয়েছে ভারতের বিভিন্ন বোর্ডের সিলেবাসে এবং ডালটনের পরমাণুবাদের ব্যাখার আগে প্রতিটি লেখক যে ভূমিকাটি দেন সেখানে তাঁরা ভারতীয় দার্শনিক কনাদের কথা উল্লেখ করেন। পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা সম্পর্কে ধারণাও ভারতীয় দার্শনিকরা দিয়ে গেছেন। সে সময়ে প্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না, রিসোর্সের অনেক অভাব ছিল তারপরেও এই সমস্ত ধারণা বেদে লিপিবদ্ধ করা রয়েছে বিভিন্ন শ্লোকের মাধ্যমে। যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক ধারণা বেদে রয়েছে তারমধ্যে কিছু বৈজ্ঞানিক ধারণা সম্পর্কে আজকে আমরা জানব।
প্রথম পর্ব: সনাতন ধর্মে ঋষি এবং বেদের ভূমিকা জানুন
স্কুল পাঠ্য বইতে আমরা সকলেই পড়েছি আলোকবিজ্ঞান। এই অধ্যায়ে পড়েছি যে আলোর গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ১৮৬২৮২.৩৯৭ মাইল। কিন্তু জানেন কী প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় আলোর গতিবেগ গণনা করা হয়েছিল। গণনার হিসাব বর্তমান বিজ্ঞানীদের গণনার খুব কাছাকাছি এসেছিল। বৈদিক সভ্যতা অনুযায়ী আলোর গতিবেগ হল প্রতি সেকেন্ডে ১৮৫৭৯৩.৭৫ মাইল। কীভাবে আলোর গতিবেগ নির্ণয় করা হল, এবার আমরা জানবো।
আলোকের গতিবেগ সম্বন্ধে বৈদিক ঋষিরা বলেছিলেন:
“যোজনম্ সহস্ত্রে দোয়ে, দোয়ে শতে, দোয়ে চঃ যোজনে।
একিনম্ নিমির্ষাদ্ধেন কর্মেনঃ নমস্তুতে।।” (ঋকবেদ ১.৫০.০৪)
আসুন এবার শ্লোকটিকে আমরা ব্যাখ্যা করি।
ঋকবৈদিক যুগে (Vedic Civilization) সময় এবং দূরত্বের বিভিন্ন একক ছিল। এগুলি হল নিমেষ, মুহূর্ত, কলা, কষ্ঠ, যোজন ইত্যাদি।
১ দিবারাত্রি = ৩০ মুহূর্ত = ২৪ ঘণ্টা
১ মুহূর্ত = ৩০ কাল = ২৪/৩০ ঘণ্টা
১ কাল = ৩০ কষ্ঠ = ২৪/৩০×৩০= ১.৬ মিনিট
১ কষ্ঠ = ১৫ নিমেষ = ১.৬ ÷ ১৫ = ৩.২ সেকেন্ড
১ নিমেষ = ৩.২ ÷ ১৫ = ০.২১৩৩৩... সেকেন্ড
যোজন মানে ৯ মাইল। এখন যদি গণনা করা হয় তাহলে এই শ্লোক অনুযায়ী,
(২২০২×৯) ÷ (০.২১৩৩৩/২ সেকেন্ড)= ১৮৬২৮২.৩৯৭ মাইল/সেকেন্ড।
আধুনিককালের বিজ্ঞানীরা গণনার মাধ্যমে নির্ণয় করতে পেরেছেন পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব। অপসূর হয় ৪ জুলাই এবং অনুসূর হয় ৩ জানুয়ারি। অনুসূরের সময় সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব সব থেকে কম হয় এবং অপসূরের সময় সবথেকে বেশি থাকে। অপসূরের সময় সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব হয় ১৫ কোটি ২০ লক্ষ কিলোমিটার। অনুসূরের সময় দূরত্ব হয় ১৪ কোটি ৭০ কিলোমিটার। জানেন কী পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের কথা হনুমান চালিশাতেও রয়েছে। প্রতি মঙ্গলবার বজরংবলীর পূজা আমরা করি। হনুমান চালিশা নিয়মিতভাবে পাঠ করি এবং সেখানকার ১৮ তম শ্লোকটি হল,
যুগ সহস্র যোজন পর ভানু।
লীল্যো তাহি মধুর ফল জানু।।
আসুন এবার গাণিতিক প্রয়োগ করে বিষয়টি স্পষ্ট করি।
১ যুগ = ১২০০০ বছর
১ সহস্র = ১০০০
১ যোজন = ৯ মাইল
যুগ সহস্র যোজন = ১২০০০ × ১০০০ × ৯ = ১০৮,০০০,০০০ মাইল
১ মাইল = ১.৬ কিলোমিটার।
১০৮,০০০,০০০ × ১.৬ = ১৭২,৮০০,০০০ কিলোমিটার
এবার NASA প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী পৃথিবী থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব কত জানেন? দূরত্বটি হল প্রায় ১৪,৯৬,০০০ কিলোমিটার।
স্যার আইজ্যাক নিউটনের বাগানে বসে আপেল পরা দেখার অনেক আগেই মহাকর্ষ বল এবং অভিকর্ষ বল সম্পর্কে ধারণা দিতে পেরেছিলেন প্রাচীন ভারতীয় ঋষিরা। পৃথিবী সব বস্তুকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে এটাই হল অভিকর্ষ বল এবং মহাবিশ্বের যেকোনো দুটি বস্তু কণা তাদের কেন্দ্র সংযোগকারী সরলরেখা বরাবর পরস্পর পরস্পরকে নিজের কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে এটাই হলো মহাকর্ষ বল। অর্থাৎ মহাবিশ্বের প্রত্যেকটি বস্তু একে অপরকে আকর্ষণ করে। এবার বেদে এই বিষয়ে কী বলা হচ্ছে জানা যাক।
"আকৃষ্ণেণ রজসা , বর্তমানো নিবেশয়ন্নমৃতং মর্তং চ।
হিরণ্যেন সবিতা রথেনা দেবো যাতি ভুবনানি পশ্যান।।"
শ্লোকটির অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, শূন্যে প্রদক্ষিণরত সূর্য তার আকর্ষণ শক্তির প্রভাবে পরিবারের সকল জাগতিক বস্তুকে অর্থাৎ কিনা সৌরজগতের প্রত্যেকটি গ্রহসমূহকে যথাস্থানে রাখে। কথিত আছে, এক গণিতবিদ প্রাচীনকালে তীর নিক্ষেপ দেখছিলেন এবং ভাবছিলেন যে তীরগুলি মাটিতেই কেন পড়ছে? তারপর তিনি বেদের এই শ্লোকটি সম্পর্কে অধ্যয়ন করেন এবং পরবর্তীকালে সিদ্ধান্ত শিরোমনি গ্রন্থে লেখেন,
"আকৃষ্টিশক্তিশ্চ মহীতয়া যৎ স্বস্থং গুরুং স্বাভিমুখং স্বশক্ত্যা"
এর অর্থ হল, পৃথিবী সমস্ত গুরু বস্তুকে তার নিজের দিকে আকর্ষণ করে। এটাই তো অভিকর্ষ বলের সংজ্ঞা।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook এবং Twitter পেজ।
Tags: