উৎসবের মরশুমে আজ কার্তিক পুজোর আনন্দে মেতেছে বাঙালি...
দেবসেনাপতি কার্তিক (ফাইল ছবি)
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: নবদম্পতির বাড়ির সামনে কার্তিক (Kartik Puja) রেখে এসেছে, এমন বন্ধু আমাদের পরিচিত মহলে নিশ্চয়ই রয়েছে। স্বয়ং মহাদেব-পুত্র তাঁদের বাড়িতে এসেছেন বলে কথা! গৃহকর্তা বা কর্ত্রীকে তাই পরপর চার বছর এই পুজো করতে হয়। কিন্তু বাড়ির সামনে কার্তিক ঠাকুরই বা কেন রাখা হয়? নিছক মজার উদ্দেশ্যেই নবদম্পতির বাড়ির সামনে কার্তিক ঠাকুর রাখা হয় না। এর মধ্যে লোকাচার রয়েছে। কী সেই লোকাচার? নবদম্পতির কোলে যেন কার্তিকের মতো পুত্র আসে। হঠাৎ কার্তিকের মতো পুত্রের আকাঙ্খা কেন? এর জন্য আমাদের জানতে হবে একটি পৌরাণিক আখ্যান।
কার্তিকের পৌরাণিক কাহিনী
পুরাণ অনুযায়ী, দেবাদিদেব মহাদেবের পুত্র হলেন দেব সেনাপতি কার্তিক (Kartik Puja)। তাঁর অপর নাম স্কন্দ। স্কন্দমাতা মানে হল কার্তিকের মাতা। দেবী পার্বতীর এই রূপেরই পুজো করা হয় নবরাত্রির পঞ্চমীর দিন। পৌরাণিক আখ্যান অনুযায়ী, বজ্রাঙ্গ নামে এক অসুর রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন দিতির পুত্র। দেবতাদের রাজা ইন্দ্রকে বজ্রাঙ্গ সিংহাসনচ্যুত করে, বন্দি করেন। দেবতাদের প্রতি বজ্রাঙ্গের এই রোষ আসলে ছিল তাঁর প্রতিশোধ। কারণ ইতিপূর্বে দিতির অসংখ্য পুত্রকে মানে বজ্রাঙ্গের নিজ ভাইদের দেবতারা হত্যা করেছিল। বজ্রাঙ্গের হাতে বন্দি ইন্দ্রকে মুক্ত করতে আসেন ব্রহ্মা এবং কাশ্যপ মুনি। কাশ্যপ মুনি ছিলেন বজ্রাঙ্গের পিতা, অর্থাৎ দিতির স্বামী। ব্রহ্মা এবং কাশ্যপ মুনির অনুরোধে বজ্রাঙ্গ তখনকার মতো ইন্দ্রকে মুক্ত করেন।
দৈত্য হয়েও এমন দয়ার ভাব বজ্রাঙ্গের মধ্যে দেখতে পেয়ে ব্রহ্মা তাঁকে বরদান করতে ইচ্ছাপ্রকাশ করলেন। বজ্রাঙ্গ তখন তপস্বী হওয়ার বর প্রার্থনা করলেন এবং বাকি জীবন যেন তিনি ধর্ম পথে চলতে পারেন, সেই আশীর্বাদ ব্রহ্মার কাছে চাইলেন। ব্রহ্মা তাঁর মানসকন্যা বরাঙ্গীর সঙ্গে বজ্রাঙ্গের বিবাহ দিলেন। বজ্রাঙ্গ এবং বরাঙ্গী বনের মধ্যে কুটির বানিয়ে ধর্মকর্ম করতে লাগলেন। বজ্রাঙ্গ তপস্যায় রত থাকতেন এবং বরাঙ্গী গৃহকর্ম সম্পাদন করতেন।
একদিন দেবরাজ ইন্দ্র ওই কুটিরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বরাঙ্গীকে দেখতে পেয়ে পুরনো অপমানের বদলা নিতে চাইলেন। কখনও বানর সেজে, কখনও ভেড়া বা কখনও সাপ হয়ে কুটির লন্ডভন্ড করতে লাগলেন। ক্রন্দনরত অবস্থায় বরাঙ্গী তাঁর স্বামী বজ্রাঙ্গকে এসব বিষয়ে বললে, বজ্রাঙ্গ ব্রহ্মাকে স্মরণ করলেন। ব্রহ্মা প্রকট হয়ে বর দিতে চাইলে বজ্রাঙ্গ বললেন, ‘‘আমাকে এমন পুত্র দিন, যে দেবতাদের উপর অত্যাচার করতে সমর্থ হবে।’’ ব্রহ্মা বজ্রাঙ্গের মনোমত বরদান করলেন। বরাঙ্গীর গর্ভে জন্ম হল তারক নামের অসুরের।
পরবর্তীতে তারকাসুরের উপর ব্রহ্মার বরদান ছিল যে- ‘‘একমাত্র শিবের বালকপুত্র ছাড়া, কারও হাতে তিনি হত হবেন না।’’ ব্রহ্মার বরদানে অজেয়, অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন তারকাসুর। কারণ তিনি জানতেন শিব কখনও বিবাহ করবেন না এবং ত্রিভুবনে ব্রহ্মার বরদানে তাঁকে হত্যা করতে পারে এমন ক্ষমতা কোনও দেবতা, মানুষ বা জীবজন্তুর নেই। তারকাসুর দেবলোক নিজের দখলে আনেন। দেবরাজ ইন্দ্র সিংহাসনচ্যুত হলেন। বিতাড়িত দেবতারা বুঝতে পারলেন শিবের বিয়ে দিতে পারলে তবে তাঁর পুত্রই তারকাসুরকে বধ করতে পারবেন।
আয়োজন শুরু হল শিব-পার্বতীর বিবাহের। সেখানেও তারকাসুরের আক্রমণ হল। সেই সময় মাতা চন্দ্রঘন্টার রূপ ধারণ করে পার্বতী দেবী অসুরদের বিতাড়িত করেন। এরপর সুসম্পন্ন হয় শিব-পার্বতীর বিবাহ। জন্ম হয় কার্তিকের (Kartik Puja)। মাতা পার্বতী তখন হন স্কন্দমাতা অর্থাৎ কার্তিক জননী। দৈববাণী পেয়ে দেবরাজ ইন্দ্র কার্তিককে সেনাপতি নিযুক্ত করলেন। এক প্রবল যুদ্ধে কার্তিকের হাতে তারকাসুর হত হলেন। দেবতারা তাঁদের হৃত স্বর্গরাজ্য পুনরায় নিজেদের দখলে আনলেন। এমনটাই লেখা রয়েছে 'স্কন্দপুরাণে'। শিব-পার্বতীর পুত্রের জন্মই হয়েছিল তারকাসুরের বধ এবং স্বর্গ রাজ্যে দেবতাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য। তাই প্রতিটি সন্তান যেন 'কার্তিক' এর মতো হয় এই কামনায় বাড়ি বাড়ি পুজো হয় কার্তিকের।
বাংলায় কার্তিক পুজো (Kartik Puja) প্রায় সর্বত্রই হয়, এর মধ্যে হুগলির বাঁশবেড়িয়া এবং পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ার কার্তিক পুজো ব্যাপক জনপ্রিয়। এই দুই জায়গায় কার্তিক পুজোকে কেন্দ্র করে উৎসবে মাতেন লাখ লাখ মানুষ। সুসজ্জিত আলোর মালা, মণ্ডপসজ্জার কারুকার্য, বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবীদের বিশালাকার প্রতিমার সঙ্গে থাকে নানা রকমের বাজনা। চলতি বছরে কাটোয়ার একাধিক পুজো মণ্ডপে আগের দিন থেকেই ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিউ আপনজন, জনকল্যাণের মতো ক্লাবগুলিতে এবারও থিমের পুজো লক্ষ্য করা যাবে। কাটোয়ার কার্তিক পুজো রাজ্যজুড়ে জনপ্রিয় কার্তিক লড়াই নামে। ১৭৫০ নাগাদ ধুমধাম করে কাটোয়াতে কার্তিক পুজোর সূত্রপাত হয় বলে জানা যায়। অন্যদিকে বাঁশবেড়িয়াতেও কার্তিক পুজোর বেশ ধুমধাম চোখে পড়ছে। যেমন, চলতি বছরে ৪৮ বর্ষে পদার্পণ করছে বাঁশবেড়িয়ায় অনির্বাণের জামাই কার্তিক পুজো। বিগত বছরগুলিতে একের পর এক দারুণ থিম নিয়ে এসেছে এই অনির্বাণ। আর এবার তাদের থিম নয়া সংসদ ভবন।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook, Twitter এবং Google News পেজ।