The Great Calcutta Killing: সুরাবর্দির নির্দেশে শুরু ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে‘, কলকাতায় হয়েছিল ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং‘ — বাঙালি হিন্দুদের কাছে এক অন্ধকার অধ্যায়...
দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং... ফিরে দেখা ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা। ছবি—প্রতীকী।
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: জ্বলছে বাংলাদেশ। মনের হিংসা পুড়িয়ে দিচ্ছে সভ্যতার দলিল। উন্মত্ত জনতার হাতে বলি হচ্ছে বহু হিন্দু পরিবার। বলি হচ্ছে বিএনপি-জামাত বিরোধীরা। খুন করে উল্টে টাঙিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেহ। আজ যখন বাংলাদেশে এই অবস্থা, তখন আমরা একটু পিছন দিকে ফিরে দেখার চেষ্টা করব (Direct Action Day)।
সময়টা ছিল ১৯৪৬। তখনও দেশ ভাগ হয়নি। তবে স্বাধীনতার তোড়জোড় চলছে। দেশে তৈরি হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ভারতের হাতে শাসন ক্ষমতা তুলে দেওয়ার বিষয়টি দেখভাল করার জন্য ব্রিটেন থেকে পাঠানো হয়েছে ক্যাবিনেট মিশনকে। দিল্লিতে থেকে পুরো বিষয়টি তদারকি করছেন ভাইসরয় লর্ড ওয়েভেল। প্রায় প্রতিদিনই আলোচনা চলছে। মুসলিম লিগ আলাদা পাকিস্তানের দাবিতে অনড়।
১৯৪০ সালের লাহোর অধিবেশন থেকেই মুসলিমদের আলাদা দেশ তৈরির জন্য উঠে পড়ে লাগেন মহম্মদ আলি জিন্না। চল্লিশের দশকের শুরু থেকেই বাড়তে থাকে হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে অশান্তির ঘটনা।অবিভক্ত বাংলায় তৈরি হয় সুরাবর্দীর সরকার। মনে রাখতে হবে, সেসময় অখন্ড বাংলায় মুসলিমদের সংখ্যা সামান্য বেশি ছিল। হিন্দুরা ছিল ৪৭ শতাংশ। মুসলিম প্রায় ৫২ শতাংশের ওপর। এই প্রেক্ষিতেই প্রাদেশিক সরকার তৈরি করে মুসলিম লিগ। যার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সুরাবর্দী। (সেই সময় বাংলায় মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছিল না। প্রদেশের প্রধানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই উল্লেখ করা হত।)
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে। চার্চিলের পর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ক্লেমেন্ট অ্যাটলি। সিদ্ধান্ত হয়েছে, ১৯৪৮ সালের মধ্যে ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে। কিন্তু কীভাবে এই কাজটা হবে, কতটা মসৃণভাবে করা যাবে, তার জন্যই চলছে আলোচনার পর আলোচনা। নেহরুর নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেখানে মুসলিম লিগ কখনও ঢুকছে, কখনও বেরোচ্ছে। বলা চলে, সরকার গঠন নিয়ে খেলা করছে। এই পরিস্থিতিতেই ১৯৪৬ সালের ৭ এপ্রিল দিল্লিতে ৩ দিনের কনভেনশনের ডাক দেন জিন্না। সেখানে ডাকা হয় লিগপন্থী সমস্ত কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রাদেশিক নেতাদের। বাংলা থেকে যোগ দিতে যাওয়ার জন্য একটা গোটা ট্রেনেরই ব্যবস্থা করে ফেলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দী। তাতে অংশ নিয়েছিলেন শেখ মুজিবুরও। তিনি তখন কলকাতার কলেজের ছাত্র।
এই কনভেনশন থেকেই ১৬ অগাস্ট দেশজুড়ে ‘ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে’ (Direct Action Day) বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেন জিন্না। স্লোগান ওঠে, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। মানে, যে কোনও ভাবেই হোক আদায় করতে হবে পাকিস্তান। হিসেব বলছে, দেশে তখন প্রায় ৪০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় দশ কোটি। এর মধ্যে বাংলা ও পাঞ্জাবে সংখ্যায় বেশি মুসলিমরাই।
ডায়রেক্ট অ্যাকশন প্ল্যান ডাক দেওয়াই নয়, সেই মতো প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। অগাস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে এর উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ১৬ অগাস্ট সরকারি ভাবে ছুটি ঘোষণা করেন তৎকালীন অখণ্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দী। ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলা সংবাদপত্র আজাদের সম্পাদকীয়তে লেখা হল, ১৬ অগাস্ট থেকে পাকিস্তানের জন্য যুদ্ধ শুরু হবে। মৌলানা আক্রম খান পবিত্র রমজান মাসে কাফেরদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার দায়িত্ব স্মরণ করালেন। আর শুক্রবার ময়দানে জমায়েতের ডাক দিল মুসলিম লিগ।
সেদিন দুপুর ২টোর দিকে সমাবেশ শুরু হয়, যদিও নামাজের পর থেকেই কলকাতার সব জায়গা থেকে মুসলমানদের মিছিল জড়ো হতে শুরু করে (The Great Calcutta Killing)। অংশগ্রহণকারীদের একটি বিশাল অংশের হাতে ছিল লোহার রড ও লাঠি। সমাবেশে হাজির ছিল বিপুল মানুষ। প্রধান বক্তা হিসাবে খোয়াজা নাজিমউদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী হোসেন শাহিদ সুরাবর্দী ছিলেন। তাঁরা সেই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মুসলিম জনতাকে যথেষ্ট উত্তেজিত করলেন, গর্জন উঠতে থাকল সভা থেকে। দীনেশ চন্দ্র সিনহা তাঁর ১৯৪৬ কলকাতা হত্যা বইতে লিখেছেন, সুরাবর্দী নাকি সেখানে বলেছিলেন, তোমাদের ২৪ ঘণ্টা সময় দেওয়া হল, যা করার তাই করো। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের তরফে জানা যাচ্ছে, সোরাবর্দীর প্রাথমিক প্রচেষ্টা ছিল - যাতে কোনও পুলিশ এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে। তিনি সামরিক বাহিনী ও পুলিশকে আটকাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সেই সময়ের হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড কাগজের প্রথম পাতায় খবরে দেখা যাচ্ছে, তিন দিনের হিংসায় ২ হাজার জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৮ হাজার জন (Direct Action Day)। সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে কয়েক কোটি টাকার। হাসপাতালে যেসব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করছিলেন এবং রেড ক্রস সূত্রে এই খবর পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু বাস্তব সত্য হল, অনেকেই সেদিন হাসপাতালে যেতে পারেননি। রাস্তায় পড়ে মৃত্যু হয়েছে বহু মানুষের।
১৬ অগাস্ট সকাল দশটা পর্যন্ত সব কিছু শান্তই ছিল। ৩০ অগাস্টের পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে জানা যাচ্ছে, আড়াইশ-তিনশ জন মুসলিম আচমকা হামলা শুরু করে চোরবাগান এলাকায়। লাঠি, ছুরি, কুকরি নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে ওই এলাকায়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি ১৮ বছরের ছেলেকে কুপিয়ে মারে। এরপর এগিয়ে যায় মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের দিকে। সেখান থেকে ফিরে এসে একটি ধরমশালায় ঢুকে ৬ জনকে কুপিয়ে মারে। চলে নির্বিচারে লুঠপাট।
হ্যারিসন রোড ও ধর্মতলা স্ট্রিটে কয়েক হাজার দোকান ও বাড়িতে লুঠপাট করা হয়। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় সেখানে। সোনার দোকান থেকে সবকিছু লুঠ করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। খবরের কাগজ থেকে জানা যাচ্ছে, সব মিলিয়ে প্রায় আড়াই হাজার দোকান ও বাড়িতে আগুন লাগানো হয়। ক্ষতি হয় প্রায় ৫ কোটি টাকা (The Great Calcutta Killing)।
১৬ অগাস্ট দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে মানিকতলা, টেরেটি বাজার, চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউ, বিডন স্ট্রিট এলাকায়। শিয়ালদা স্টেশনের কাছে এক হিন্দু পরিবারকে কোপানো হয়। ওই পরিবারের কিশোরী কন্যাকে চৌরাস্তায় নগ্ন করে হাঁটানো হয়। ধর্মতলা, রিপন স্ট্রিট, চাঁদনি চক, গরপার, হ্যারিসন স্ট্রিট, মল্লিক বাজার --- এসব এলাকায় দাপাতে শুরু করে মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের দাঙ্গাকারীরা।
১৬ অগাস্ট নরসংহারের সবচেয়ে বড় ছবি পাওয়া যায় মেটিয়াবুরুজে (Direct Action Day)। সেখানে ৬০০ জন হিন্দু খুন হন। তাদের বেশিরভাগই ওড়িয়া। তাঁরা থাকতেন কেশোরাম কটন মিলের পিছনে। লিচুবাগানে। সকলেই শ্রমিক। এই হামলা চলাকালীন দিলখুশ স্ট্রিটে চলচ্চিত্র অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের বাড়ির ওপর আক্রমণ হয়। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ইতিহাসবিদ স্যার যদুনাথ সরকারের বড় ছেলেকে। মৃত্যু হয় মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী ভীমচন্দ্র নাগের সন্তানের। বলা হয়, এত লাশ পড়েছিল সেদিন যে শহরে রক্তগঙ্গা বয়েছিল। কলকাতার আকাশ ছেয়ে গিয়েছিল শকুনে।
তবে, নৃশংসতার সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ দেখা গিয়েছিল ভিক্টোরিয়া কলেজে। সেখানে ঢুকে একের পর এক হিন্দু মেয়েদের গণধর্ষণ করে লিগের গুন্ডারা। তাদের জনপ্রিয় স্লোগান ছিল, 'হাতে বিড়ি মুখে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।' শুধু তাই নয়, রাজাবাজারের মাংসের দোকানে হিন্দু মেয়েদের নগ্ন দেহ হত্যা করার পর টাঙিয়ে দেওয়া হয়। হত্যার পর কয়েকজনের বক্ষদেশ শরীর থেকে আলাদা করে কলেজের দেওয়ালে টাঙিয়ে দিয়েছিল গুন্ডারা। শোনা যায়, কলেজের যে হলে ওই নৃশংস কাণ্ড ঘটানো হয়েছিল, তা সেদিন থেকে তালাবন্ধ অবস্থাতেই রয়েছে।
ক্রমশ পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে হিন্দুরাও আত্মরক্ষার জন্য জায়গায় জায়গায় সঙ্ঘবদ্ধ হতে শুরু করে। এই সময় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন গোপাল মুখোপাধ্যায়। যিনি এলাকায় পরিচিত গোপাল পাঁঠা নামে। বউবাজার এলাকায় তাঁদের পারিবারিক মাংসের দোকান ছিল। তাই ওই নামেই সবাই তাঁকে চিনত। তাঁর কাকা ছিলেন বিপ্লবী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলির অনুগামী অনুকূল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ছোটবেলা থেকেই নেতাজি সুভাষ, অরবিন্দ ঘোষের গুণমুগ্ধ ছিলেন গোপাল। শরীর গঠনের জন্য তাঁদের একটি দলও ছিল। নাম ভারত জাতীয় বাহিনী। তিনি যখন দেখেন, মুসলিম লিগের পোশা গুণ্ডা মীনা পেশোয়ারি, বোম্বাইয়ার মতো দাঙ্গাবাজরা এলাকায় হিন্দুদের কচুকাটা করছে, তখন দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন গোপাল। একজন হিন্দু মারা গেলে ১০ জন মুসলিমকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তাঁকে নিরস্ত হওয়ার ডাক দেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী। কিন্তু গোপাল বলেন, আগে দাঙ্গা বন্ধ হোক, তারপর তিনি চুপ করবেন।
তাঁর একরোখা মানসিকতার কাছেই হার মানে দাঙ্গাবাজরা (Direct Action Day)। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে সেনা নামানোর জন্য আর্জি জানান স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দী। তবে তার আগেই হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। কলকাতা ছাড়েন অসংখ্য লোক। এই দাঙ্গাকেই ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ (The Great Calcutta Killing) বলে অভিহিত করা হয়। মুলত তাঁদের এই রুখে দাঁড়ানোতেই থমকে যায় মুসলিম লিগ। থমকে যায় ইংরেজ সরকারও। কারণ, মুসলিম লিগ প্ল্যান করেছিল, কলকাতা সহ গোটা বাংলাকেই পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার। কিন্তু সেসময় রুখে দাঁড়িয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। হিন্দুদের জন্য আলাদা হোমল্যান্ডের দাবি করেছিলেন তিনি। এই উদ্যোগে সামিল হন অনেকেই। শেষে হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ তৈরি হয়।
তবে চিরকালের জন্য বাংলার বুকে ঘা রেখে যায় ১৬ অগাস্টের দাঙ্গা (The Great Calcutta Killing)। যেদিন মুসলিমদের জন্য পৃথক দেশের দাবি তুলে নিধন যজ্ঞে সামিল হয় এক শ্রেণির গুন্ডা। আর তাতে সরাসরি প্ররোচনা দেয় শাসক পক্ষ। নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে মানুষ খুন করতেও যারা পিছপা হয়নি। ১৯৪৬ সালের ১৬ অগাস্ট (Direct Action Day), বাঙালি হিন্দুদের কাছে এক অন্ধকার অধ্যায় হিসেবেই থেকে যাবে...
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।