ইভিএমের নকশা করেছিলেন এস রঙ্গরাজন, আজ তাঁর জন্মদিন, জানুন কীভাবে তৈরি হল এই ভোট মেশিন
ইভিএম ও ভিভিপ্যাট (সংগৃহীত ছবি)
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: ভোটে হারলেই ইভিএমকে (EVM) তোপ দাগেন বিরোধীরা। তাঁরা নিজেদের ব্যর্থতার দায় চাপান ইভিএমের ওপরে। বর্তমানে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে ১৮তম লোকসভা নির্বাচন। এ সময় আবার একবার খবরের শিরোনামে এসেছে ইভিএম। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট ইভিএমের স্বচ্ছতায় সিলমোহর দিয়েছে। ইভিএমের ওপর হওয়া যাবতীয় সন্দেহকে মোকাবিলা করার জন্য বেঁচে নেই আজ সেই মানুষটি, যিনি ইভিএমের নকশা করেছিলেন। তিনি এস রঙ্গরাজন।
এস রঙ্গরাজন তামিলনাড়ুতে প্রসিদ্ধ ছিলেন 'লেখক সুজাতা' নামে। তিনি ছিলেন প্রসিদ্ধ তামিল লেখকদের মধ্যে অন্যতম। যিনি থ্রিলার, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী, নাটক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি- এই সমস্ত বিষয় নিয়ে লেখা লিখতেন। তাঁর অসংখ্য চিত্রনাট্য আজও সমান জনপ্রিয়। আজ ইভিএম নির্মাতা এস রঙ্গরাজনের ৮৯তম জন্মদিন। দুর্ভাগ্যক্রমে ২০০৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এই মানুষটি পরলোকগমন করেন।
ইভিএম তৈরির ভাবনা
প্রসঙ্গত, রঙ্গরাজন ছিলেন ভারত ইলেকট্রনিক্স লিমিটেডের একজন ইঞ্জিনিয়ার। সেখানে তিনি যুক্ত ছিলেন নানা ধরনের মেশিন ডিজাইনের সঙ্গে। ১৯৮৯ সালে ইভিএম (EVM) এর পরীক্ষামূলক ব্যবহার করেন তিনি। তার পরবর্তীকালে ২০০৪ সালে প্রায় ১০ লক্ষ ইভিএমে মেশিনে ভোট হয়। ১৯৭৭ সালে এস এল শাকধর যিনি ছিলেন তৎকালীন ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার, তিনি একবার হায়দরাবাদ সফর করেন। এই সময় তিনি ইলেকট্রনিক্স কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া লিমিটেডকে তৈরি করতে বলেন এমন একটি ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস, যা পরবর্তীকালে নির্বাচন পরিচালনার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। ১৯৭৭ সালে দেশের তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এমন অনুরোধ খুঁজে পাওয়া যায় অনিল মাহেশ্বরী এবং বিপুল মাহেশ্বরীর লেখা বই ‘India's Experiment With Democracy: The Life of a Nation Through Its Elections’-তে।
১৯৮০ সালের অগাস্ট মাসে রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিদের একটি বৈঠকে ভারতের নির্বাচন কমিশন (EVM) ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনার কার্যকারিতা তুলে ধরে। ঠিক এই সময়ের মধ্যে ভারত ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড, একটি মাইক্রোকম্পিউটার ভিত্তিক ভোটিং মেশিন তৈরি করে, যা কোম্পানির বিভিন্ন ইউনিয়নের নির্বাচনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। একথা উল্লেখ রয়েছে অনিল মাহেশর এবং বিপুল মাহেশ্বরীর লেখা বই ‘The Power of the Ballot: Travail and Triumph in the Elections’-তে। ১৯৮১ সালের ২৯ জুলাই ভারত ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড ইভিএম তৈরির জন্য ভারতের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এর পাশাপাশি ভারত ইলেকট্রনিক লিমিটেড সে সময়ে বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও এ নিয়ে একপ্রস্থ বৈঠক করে।
পরবর্তীকালে ইভিএমের (EVM) ভোটে কারচুপি হচ্ছে বলে সরব হয় বেশ কিছু বিরোধী দল। ইভিএমের ওপর যখন সন্দেহ শুরু হয় তখন চালু করা হয় ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেল, যাকে সংক্ষেপে বলা হয় ভিভিপ্যাট। আমরা ভোট দিতে গেলেই বুঝতে পারি যে ইভিএম মেশিনের সঙ্গে ভিভিপ্যাট জোড়া থাকে। ভোট দেওয়ার সঙ্গেই নিজেদের ভোট যাকে দেওয়া হয়, তার প্রমাণ পত্র হিসেবে একটি স্লিপ প্রিন্ট হয়ে যায়। এই স্লিপটি ৭ সেকেন্ডের জন্য দেখা যায়। তবে তা ভোটারদের কাছে আসে না। ভিভিপ্যাটে থেকে যায়। যাঁরা গণনা কেন্দ্রে থাকেন, তাঁরা ভোট যাচাই করতে এই স্লিপগুলিকে ব্যবহার করেন।
প্রসঙ্গত, নির্বাচন প্রক্রিয়াতে আরও স্বচ্ছতা আনতেই ২০১০ সালে ভিভিপ্যাট ধারণাটি প্রস্তাব করা হয়েছিল। অবশেষে নির্বাচন কমিশন এই সংক্রান্ত প্রস্তাব তাদের প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে পাঠায়। শেষমেশ তা সংযুক্ত করা হয় ইভিএমের সঙ্গে। ২০১৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় বেশ কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ভিভিপ্যাট চালানো হয়। ২০১৯ সালে দেশের সপ্তদশ লোকসভার নির্বাচনে সমস্ত ইভিএম (EVM) মেশিনের সঙ্গে ভিপিপ্যাট সংযুক্ত ছিল।
প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এসওয়াই কুরেশি তাঁর লেখা ‘India's Experiment With Democracy: The Life of a Nation Through Its Elections’ নামের বইতে লিখছেন, "ভিভিপ্যাট মেশিনগুলি ইভিএম এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল সন্দেহ দূর করার জন্য। এছাড়া, ভোটাররা তাঁদের ভোট সঠিকভাবে দিতে পারছেন কিনা তার প্রমাণপত্র হিসেবে রাখা ছিল ভিভিপ্যাট। বেশ কিছু উপনির্বাচনে ভিভিপ্যাটকে ত্রুটিপূর্ণ পাওয়া গিয়েছে কিন্তু ইভিএম কে কখনও নয়।" কুরেশি তাঁর বইতে আরও লিখেছেন যে যতবারই কোনও রাজনৈতিক দল নির্বাচনে হেরেছে, ততবারই মেশিনকে দোষারোপ করেছে তারা। তবে তাদের কেউই প্রমাণ করতে পারেনি তাদের নিজেদের দাবি।
ইভিএমের নকশাকারী এস রঙ্গরাজন তাঁর সৃষ্টিকে রক্ষা করতে কলম ধরেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, "ইভিএম (EVM) এমন একটা আবিষ্কার যা তাঁকে তার লেখার মতোই গর্বিত করেছে।" তবুও রঙ্গরাজনের মৃত্যুর এক বছর পরে ইভিএম ফের খবরে শিরোনামে আসে। যখন প্রাক্তন জাতীয় নির্বাচন কমিশনার নবীন চাওলা তার বই 'এভরি ভোট কাউন্টস দ্য স্টোরি অব ইন্ডিয়া ইলেকশন'- এ নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে লেখেন, "ঝড় সমুদ্রে ইভিএম ক্রমশই বিধ্বস্ত হতে চলেছে।" প্রসঙ্গত, হরিপ্রসাদ নামের একজন ইঞ্জিনিয়ার, কয়েকজন আমেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানীর সহযোগিতায় দাবি করেছিলেন যে ইভিএমকে হ্যাক করা যায়। তবে হরিপ্রসাদ কোথা থেকে ইভিএম পেয়েছিলেন, সে কথা তিনি বলতে পারেননি। পরবর্তীকালে তাঁকে মুম্বইয়ের কাস্টম হাউস থেকে ইভিএম চুরির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
আজও সারা পৃথিবীব্যাপী প্রায় ২৪ দেশে ইভিএমে ভোটিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। জাতীয় নির্বাচন কমিশন ইভিএমে (EVM) যাঁরা সন্দেহ করেন তাদের উদ্দেশে নিজেদের ওয়েবসাইটে লিখেছে, "স্বঘোষিত কিছু প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং কিছু সমাজ মাধ্যমের ব্যক্তি এটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন যে ইভিএমকে কখনই কম্পিউটারের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। কম্পিউটার চলে একটি অপারেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে। ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট গুলি চলে একটি বিশেষ প্রোগ্রামের মাধ্যমে।"
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।