চিনের বাঁধ চরম বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, সতর্কতা বিশেষজ্ঞদের
প্রতীকী ছবি।
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: ব্রহ্মপুত্রে চিনের বাঁধ (China Dam) বাংলাদেশের পরিবেশ, প্রকৃতি ও কৃষির বিপর্যয় ডেকে আনবে। এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু কেন তাঁরা বলছেন এমন কথা? এটা বুঝতে হলে আমাদের যেতে হবে ব্রহ্মপুত্রের উৎস-সন্ধানে। জানতে হবে রুট। অনেকেই জানেন, ব্রহ্মপুত্র একটি আন্তঃসীমান্ত নদ, অর্থাৎ একাধিক দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত এর ধারা। চিন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র। শুধু এশিয়া নয়, বিশ্বের নদীগুলির সঙ্গে তুলনাতেও ব্রহ্মপুত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দৈর্ঘ্যে বিশ্বের ১৫ তম নদটি জল বহনে বিশ্বের নবম। হিমালয়ের উত্তরাংশে কৈলাস পর্বতের কাছে মানস সরোবরে উৎস ব্রহ্মপুত্রের। এরপর এটি ইয়ার-লুং জাংবো নামে প্রবাহিত হচ্ছে চিন-তিব্বতের পূর্বাঞ্চল দিয়ে। এরপর ভারতের অরুণাচল প্রদেশে শিয়াং নামে এটি বহমান। সেখান থেকে অসমে যখন ঢুকছে, সেখানে তার নাম দিহাং। এই অসমেই সে পাচ্ছে নতুন জলের স্রোত। দিবং ও লোহিত-দুটি বড় নদী এসে মিশছে সেই ধারায়। আর ব্রহ্মপুত্র নামে নেমে আসছে সমতলে। অসম অববাহিকাকে অতিক্রম করে ব্রহ্মপুত্র যখন বাংলাদেশে ঢুকছে, তখন পুরানো নামে কিছুটা প্রবাহিত হওয়ার পর সে নাম নিচ্ছে যমুনা। এই যমুনা মিশছে বঙ্গোপসাগরে। এই গোটা পথ আসতে ব্রহ্মপুত্রকে পার হতে হয়েছে ২ হাজার ৮৫০ কিলোমিটার পথ।
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। সব মিলিয়ে মোট ৩১০টি নদী রয়েছে। এর মধ্যে আন্তঃসীমান্ত বা আন্তর্জাতিক নদীর সংখ্যা ৫৭টি। যার ৫৪টি ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত। বাংলাদেশের পরিবেশ, প্রকৃতি ও কৃষিপ্রধান অর্থনীতি-সব দিক দিয়ে আন্তর্জাতিক নদীগুলির ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদ তথা যমুনা নদীর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।
এটাই প্রথম নয়
বিশ্বব্যপী জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এখন প্রায় সব দেশই বিকল্প জ্বালানি, বিশেষ করে জলবিদ্যুতের দিকে ঝুঁকছে। একই পথে এগোচ্ছে এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী দেশ চিন। ব্রহ্মপুত্র নদের নিজেদের অংশে ইয়ার-লুং জাংবোর ওপর আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে চিন (China Dam)। তবে এটাই প্রথম নয়, এর আগে বেজিং অন্তত আটটি বাঁধ দিয়ে বেঁধে ফেলেছে ইয়ার-লুং জাংবোকে। যার মধ্যে কয়েকটি এরই মধ্যে চালু হয়ে গেছে। বাকিগুলির কাজ চলছে। বেজিং-এর পরিকল্পনা, ইয়ার-লুং জাংবোর ওপরে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তুলবে। যা ৭০ গিগাবাইট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম এবং ওই দেশের বর্তমান তিনটি বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্পেরও তিনগুণ বড়। প্রশ্ন হল, তাহলে কি নেপাল-ভারত-বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জল-যুদ্ধ ঘোষণা করল চিন?
এর আগে, চিন মেকং নদীর উপর এগারোটি মেগা-ড্যাম নির্মাণ করেছে। যার ফলে মিয়ানমার, লাওস, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনামে কোনও পূর্ব সংকেত ছাড়াই জলের স্তর ব্যাপক ভাবে ওঠানামা করছে। একেবারে নিম্নভাটির অঞ্চল বাংলাদেশের অবস্থাও সঙ্কটে। কৃষিনির্ভর দেশ বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এর প্রভাব পড়তে চলেছে। খুবই রক্ষণশীল একটা হিসেব জানাচ্ছে, হিমালয়ের হিমবাহগুলিতে, যেগুলি আসলে হিমবাহ থেকে সৃষ্ট নদীগুলির জলের উৎস, সেখানে কম বেশি ১০০টি বাঁধ ও জলবিদ্যুত প্রকল্প গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছে চিন। সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র এবং মেকং নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে চিন প্রচুর সংখ্যক বাঁধ (China Dam) এবং ডাইক নির্মাণ করেছে। তিব্বত দখল করে, চীন ১৮টি দেশে প্রবাহিত নদীগুলির সূচনা পয়েন্টগুলি দখল করেছে। চিন কয়েক হাজার বাঁধ তৈরি করেছে, যা হঠাৎ করে জল ছেড়ে দিয়ে বন্যার সৃষ্টি করতে পারে বা কল বন্ধ করে খরা সৃষ্টি করতে পারে। এইভাবে নদীর বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করে এবং স্বাভাবিক মানবজীবনকে ব্যাহত করে চিন ব্রহ্মপুত্র নদে আরও চারটি বাঁধ তৈরি করার পরিকল্পনা করেছে, যা নদীর প্রবাহকে প্রভাবিত করবে। চিন্তা শুধু বাংলাদেশ-নেপাল বা ভারত, এই তিন দেশের নয়। পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূগোলটাকেই বদলে দিতে পারে চিনের এই পরিকল্পনা আর জলে আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা।
প্রথমত, এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব হতে পারে মারাত্মক, যার ফলে মধ্য ও নিম্ন অববাহিকায় বন্যা-খরা ঘটিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা হাতে পেয়ে যেতে পারে চিন। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাবও কম নয়। এটি একাধারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় দেশগুলির ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার নীতি। তৃতীয়ত, বাণিজ্যিক প্রভাব কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয় দেশগুলির বাজারগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা এতে অনেকটাই সহজ হবে চিনের পক্ষে । চতুর্থত, ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক প্রভাব, যা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার নিজস্ব ভূগোল-প্রকৃতি-আবহাওয়া-জলবায়ুর বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook, Twitter এবং Google News পেজ।