Pakistan: কালাশরাই ‘আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটে’র 'হারানো সন্তান'!...
কালাশ সম্প্রদায়ের নারীরা।
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: দেশটা ইসলামি। তার ওপর দেশটার নাম পাকিস্তান। সে দেশেই কোনওক্রমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন হাজার চারেক হিন্দু। এ যেন কয়েক হাজার ওয়াটের নিয়ন আলোর সামনে টিম টিম করে জ্বলা লণ্ঠন, কোনওক্রমে চালিয়ে যাচ্ছে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই! আজ্ঞে হ্যাঁ, আমরা পাকিস্তানের কালাশ (Kalash Tribe) হিন্দুদের কথাই বলছি। হিন্দুকুশ পর্বতের উপত্যকার জেলা চিত্রালে বাস করেন হাজার চারেক কালাশ সম্প্রদায়ের মানুষ। এঁরা মুসলমান নন।
হিন্দু গণহত্যার আবহেও ইসলামি এক রাষ্ট্রের বুকে এঁরা আজও উড়িয়ে চলেছেন হিন্দুত্বের ধ্বজা। মুসলমানদের কাছে এঁরা ‘কাফের’ নামে পরিচিত। যেহেতু এক সময় এই সম্প্রদায়ের প্রচুর মানুষ হিন্দুকুশ পর্বত অঞ্চলে বসবাস করতেন, তাই এই অঞ্চলের নাম ছিল ‘কাফেরস্তান’। ডুরান্ড লাইন বিভক্ত করেছে কাফেরস্তানকে। এদের একটা অংশের শাসক ছিল ব্রিটিশরা। অন্য অংশের বাসিন্দারা ছিলেন আফগান রাজা আমির আবদুর রহমানের অধীনে। নিজের অংশের প্রজাদের ধর্মান্তরিত করা হয়। এলাকার নাম বদলে রাজা করে দেন নুরিস্তান। ব্রিটিশদের অধীনে যাঁরা ছিলেন, তাঁর কালাশই রয়ে যান। এঁরা আজও সংস্কৃত ভাষা গোষ্ঠীর ইন্ডিক ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলেন।
কালাশরা (Kalash Tribe) ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন বুম্বুরেট, রুম্বুর ও বিরির এই তিন উপত্যকায়। কালাশ অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে থাবা বসাতে পারেনি মৌলবাদ। এই সম্প্রদায়ের মানুষ পাকিস্তানের শাসন মানেন না। এঁরা নিজেদের গ্রীক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সৈন্যের বংশধর বলে মনে করেন। তাই হাজার বছর ধরে লড়াই করেও কোনওক্রমে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন কালাশরা। কালাশদের দাবি, ইসলামেরও জন্মের আগে ভারতে এসেছিলেন সিকান্দার-ই-আজম (আলেকজান্ডার)। ভারত জয় করে তিনি ফিরে যান গ্রিসে। তাঁর কিছু সৈন্য হিন্দুকুশ অঞ্চলে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে গিয়ে এখানেই থেকে যান। বিয়ে করেন স্থানীয় মহিলাদের। পাকিস্তানের মুসলমানরা যাঁদের কাফের বলেন, হিন্দুকুশের সেই কাফের কালাশরা তাঁদেরই বংশধর। কালাশদের (Kalash Tribe) জীবন বড় বর্ণময়। জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় সব কিছুই নিজেরাই তৈরি করে নেন তাঁরা। জীবিকা নির্বাহের জন্য এঁরা চাষবাস করেন, করেন পশুপালনও। কালাশ সমাজে নারী-পুরুষ সবাই সমান। তবে রজঃস্বলারা বা সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময় মহিলাদের বাস করতে হয় গ্রামের প্রান্তের ‘বাশালেনি’ নামের একটি ঘরে।
হিন্দুদের মতোই কালাশরাও পৌত্তলিকতা (পুতুল পুজো) বা মূর্তিপুজোয় বিশ্বাসী। এঁদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব তিনটি। মে মাসে হয় ‘চিলাম জোশি’, শরৎকালে যে সময় হিন্দুরা পালন করেন নবরাত্রি উৎসব, সেই সময় কালাশরা পালন করেন ‘উচাউ’। আর শীতকালের মাঝামাঝি একটি সময় তাঁরা পালন করেন ‘কাউমুস’ নামের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। দেবতার বাসগৃহকে কালাশরা ‘ডেভালক’ বলেন। ‘কাউমুস’ উৎসবের সময় ‘টক’ গাছের (স্থানীয় ভাষায় জায়গাটার নাম ইন্দানকোট) কাছে জড়ো হন স্থানীয়রা। মন্দিরে হয় পুজো। পুরোহিতরা ভক্তদের গায়ে বুলিয়ে দেন জুনিপার গাছের পাতা। এই উৎসবে ছাগল উৎসর্গ করেন কালাশরা। তাঁদের বিশ্বাস, এই সময় তাঁদের দেবতা ‘বালোমেন’ ঘুরে ঘুরে শোনেন ভক্তদের প্রার্থনা। দেবতার উদ্দেশে এই সময় পাহাড়ে জ্বালানো হয় আগুন-মশাল। বাঁশি বাজিয়ে, ড্রাম বাজিয়ে সেই আগুনের চারপাশে ঘুরতে থাকেন এই সম্প্রদায়ের মানুষ। কালাশদের প্রধান দেবতা ‘বালোমেন’ হলেও, তাঁর ভাই ‘ইনডর’ও পূজিত হন। পুজো পান ‘সরিযান’, ‘গসিদাই’, ‘মুনজেম’ ‘মালিক’, ‘মাহানদিও’, ‘দেজাউ’, ‘জেস্টাক’, ‘ডেজলিক’ নামের দেবতারাও। অর্থাৎ হিন্দুদের মতোই কালাশরাও ঈশ্বরের বহুত্বে বিশ্বাসী। কালাশদের বিশ্বাস, ‘বালোমেনে’র রুদ্ররূপ হলেন ‘জেস্টান’। কুকুরের রূপ ধরে পৃথিবীতে আসেন তিনি।
সংস্কৃত ভাষা নিয়ে চর্চা করেন মিখাইল উইটজেল। ‘দ্য ওরিজিনস অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস মিথোলজিস’ গ্রন্থে তিনি বলেছেন, “কালাশ ধর্মের কিছু প্রবাদ, আচার এবং সমাজব্যবস্থার সঙ্গে ঋগ্বেদে বর্ণিত তথ্যের মিল আমি পেয়েছি।” তিনি মনে করেন, কালাশরা প্রাচীন বৈদিক ধর্ম পালন করেন। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ অবশ্য ২০১৪ সালে লিখেছিল, “কালাশদের ডিএনএ বলছে, তাঁরা প্রাচীন ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর বংশোদ্ভুত।” মাইট্রোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ রিপোর্ট বলছে, এশিয়ার সঙ্গে কালাশ উপজাতির জিনগত কোনও সম্পর্ক নেই, মিল রয়েছে পাশ্চাত্যের ইউরেশিয়ানদের।
আর পড়ুন: “আরএসএসে ছিলাম, ফিরে যেতেও প্রস্তুত”, অবসর নিয়ে বললেন বিচারপতি দাশ
ইউনিভার্সিটি মাস ডার্টমাউথের ইসলামিক স্টাডির অধ্যাপক তথা লেখক ব্রায়ান গ্লিন উইলিয়াম “দ্য লস্ট চিল্ড্রেন অফ আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট: আ জার্নি টু দ্য পাগান কালাশ পিপল অফ পাকিস্তান” শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন”, ঊনবিংশ শতাব্দীতে কালাশ উপজাতিকে নির্মমভাবে শেষ করার চেষ্টা করেছিল আফগানরা। তাঁদের প্রাচীন মন্দির ও দেবতার কাঠের মূর্তি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। তবে তাঁদের জীবনযাত্রার বিভিন্ন চিহ্ন, সমাজব্যবস্থার ধরন, সংস্কৃতিগত প্রমাণ ও ডিএনএ রিপোর্টও প্রমাণ করতে চলেছে তাঁরা আলেকজান্ডারের সৈন্যদের বংশধর।”
পণ্ডিতদের একটা অংশের মতে, কালাশরা হিন্দু। নুরিস্তানকে তাঁরা বলেছেন প্রাচীন হিন্দুধর্ম। খ্যাতনামা নুরিস্তান ভাষাতত্ত্ববিদ রিচার্ড স্ট্র্যান্ড বলেন, “ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার আগে নুরিস্তানের বাসিন্দারা প্রাচীন হিন্দু ধর্ম পালন করতেন (Kalash Tribe)।”
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।