‘অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশন’-এর উৎপত্তি কীভাবে?
প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: ‘অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশন’ (OIC) যা আগে পরিচিত ছিল ‘অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কনফারেন্স’ নামে, এই সংগঠন দাবি করে যে, তারাই মুসলিম দেশগুলির কন্ঠস্বর এবং যে, তারাই বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার কাজ করে থাকে। ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ মিলিয়ে ৫৭টি দেশ এই সংস্থার সদস্য হিসেবে রয়েছে। বিগত কয়েক দশক ধরেই রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা, আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, সন্ত্রাসবাদ - আরবসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশকেই গ্রাস করেছে। একটি রিপোর্ট বলছে, বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ সংঘাত ও সন্ত্রাস সংক্রান্ত প্রাণহানির ঘটনা ঘটে শুধুমাত্র ‘অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশন’ (OIC)- এর সদস্য দেশগুলিতে।
তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরেই তার বিকল্প ভাবা শুরু করেন কয়েকজন। উদ্দেশ্য ছিল, অটোমানদের রেখে যাওয়া আদর্শ সারা বিশ্ব জুড়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের অভিন্ন চেতনার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠবে। প্রথমে বহু মুসলিম দেশ অংশগ্রহণ করে ১৯২৬ সালের মে মাসে মিশরের কায়রোতে। সেখানে গঠিত হয় 'মুসলিম বিশ্ব কংগ্রেস' নামের একটি নতুন সংস্থা, মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। কিন্তু পরবর্তীকাল থেকেই দেখা যায় গঠনের পর থেকেই এর উদ্দেশ্য কখনও সফল হয়নি। কারণ বেশিরভাগ মুসলিম দেশগুলির মধ্যে মতবিরোধ প্রকাশ্যে আসতে থাকে এবং অনেক দেশই মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার দাবিদার হয়ে ওঠে। যার মধ্যে পাকিস্তানও ছিল। মুসলিম বিশ্বের নেতাদের নিয়ে পাকিস্তান দুটি সম্মেলন করে। একটি ১৯৪৯ সালে, অপরটি ১৯৫১ সালে। প্রতিটি বৈঠকেই প্যালেস্তাইন মুসলিম বিশ্বে শিক্ষার প্রসারের জন্য তহবিল গঠনের প্রস্তাব দেয়। এমন প্যান-ইসলামিক সত্ত্বার সর্বদাই বিরোধ করে তুরস্ক। পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর কথাতেও ফুটে ওঠে বিরোধের সুর। প্রাক্তন পাক প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দি বলেছিলেন, "মুসলিম ঐক্য হল, শূন্যের সংগ্রহ, যা শূন্যই তৈরি করে।" যদিও প্যান ইসলামিক সত্ত্বাকে বজায় রাখার জন্য সর্বদাই গলা ফাটিয়েছে প্যালেস্তাইন। ১৯৬৯ সালের ২১ অগাস্ট জেরুসালেম শহরের আল আকসা মসজিদে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর ঠিক চারদিন পরে কায়রোতে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলভুক্ত দেশগুলির বিদেশ মন্ত্রীদের একটি জরুরি বৈঠক ডাকা হয়। কিন্তু সেখানে আরব দেশের নেতারা বলেন, আল-আকসা মসজিদে অগ্নিসংযোগের ঘটনা একটি বিরাট ইস্যু এবং এর জন্য প্রয়োজন রয়েছে সমস্ত মুসলিম বিশ্ব নেতাদের সম্মেলনের। এই ভাবেই ১৯৬৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর অপর একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত (OIC) হয় রাবাতে। যেখানে ২৫টি মুসলিম দেশ অংশগ্রহণ করে। যার মধ্যে ১০ জন রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। কিন্তু এখানেও দেখা যায় মিশর, আলজেরিয়ার মতো দেশগুলি রাবাত বৈঠকে অংশগ্রহণ করলেও ইরাক, সিরিয়ার মতো দেশগুলি তা বয়কট করে। অর্থাৎ এখানেও এক ধরনের মতবিরোধ সামনে আসে এবং প্রশ্নের মুখে পড়ে সারা বিশ্বব্যাপী মুসলিম ঐক্য।
পরবর্তীকালে, ১৯৭২ সালে জেড্ডায় ওআইসির তৃতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বেশ কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। ইসলামিক শিক্ষা প্রচার, আন্তর্জাতিক ইসলামিক সংবাদ সংস্থা প্রতিষ্ঠা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা প্রভৃতি বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। বিভিন্ন কমিটিও গঠন করা হয় যার নেতৃত্বে রাখা হয় মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানদের। বিগত পাঁচ দশক ধরে ওআইসি এমন ৫৬টি বিদেশ মন্ত্রকের পর্যায়ের বৈঠক করেছে। ১৪টি শীর্ষ সম্মেলনে করেছে। এর পাশাপাশি অসংখ্য জরুরি বৈঠক হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে একাধিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও এর বেশিরভাগ সদস্য দেশই আন্তর্জাতিক ইসলামিক নীতি সম্পর্কে ব্যাপক অজ্ঞ। বারবার বিতর্কের মধ্যেও থেকেছে ওআইসি (OIC)। যেমন ১৯৮১ সালেই ওআইসি তৃতীয় ইসলামিক সম্মেলনে লেবাননের প্রেসিডেন্টকে বয়কট করে। কারণ তিনি ছিলেন একজন খ্রিস্টান। তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। কারণ এক্ষেত্রে ওআইসি-র যুক্তি ছিল যে একজন অমুসলিম মক্কায় কখনও প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু যদিও ওআইসি সর্বদা নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ বলেই জাহির করে এসেছে। আবার যখন ওআইসি দেশ হিসেবে ভারতের সদস্য হওয়ার সম্ভাবনার কথা উঠে আসে তখন প্রতিবেশী পাকিস্তান বিরোধিতা করে যে ভারতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমান নেই, তাই একে সদস্যপদ দেওয়া যাবে না। অন্যদিকে, ১৯৭৪ সালে উগান্ডা একটি খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে ওআইসি সদস্য করা হয়। ওআইসির সংবিধানে বলা হয়েছে যে যারা ইসলামিক দেশ, তারাই এর সদস্য হবে। কিন্তু তুর্কি ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তবুও একে সদস্য করা হয়েছে। আলজেরিয়ার ক্ষেত্রে একই কথা খাটে। তাই যখন ওআইসির নাম পরিবর্তন করা হচ্ছিল, তখন অনেকেই এটাকে 'অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক স্টেটস' বা 'অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কান্ট্রিস' হিসাবে নামকরণ রাখার কথা বলেন। কিন্তু এর সমস্ত সদস্য মুসলিম রাষ্ট্র নয় বলে ভিতর থেকেই বাধা আসে।
ওআইসির ভিতরে আরব অঞ্চলের দেশগুলি এবং যারা আরব অঞ্চলের বাইরে পড়ে, সেই দেশগুলির মধ্যে একটি সুস্পষ্ট বিভাজন রয়েছে। আভ্যন্তরীণ বিবাদ, রাজনৈতিক বিবাদ, মতাদর্শগত বিবাদে ওআইসি জন্মের পর থেকেই ভুগছে। ১৯৮৪ সালে ওআইসিতে মিশর প্রত্যাবর্তন করে এবং মিশরের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধ দেখা যায় সদস্য সাতটি দেশের। সাম্প্রতিক অতীতে ২০১৬ সালে ওআইসির বিদেশমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে, প্রথমবারের মতো ইয়েমেন ও সিরিয়ার মতো দেশগুলি ইরানের বিরুদ্ধে এবং সৌদি আরবের পক্ষে খোলাখুলি ভাবে সমর্থন জানায়। ২০১৯ সালে হুথিদের সমর্থন করার জন্য ইরানের নিন্দা করে ওআইসি (OIC)। হুথি হল একটি ইরান কেন্দ্রিক জঙ্গি সংগঠন। এরপর ইরান বলে, কতকগুলি দেশ ইরানের নিন্দা করেছে, এটা ওআইসির আনুষ্ঠানিক বিবৃতি নয়।
ওআইসি-র সদস্য হিসেবে পাকিস্তান সর্বদাই কাশ্মীর ইস্যুতে অন্যান্য দেশের সাহায্য চেয়েছে। ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান ওআইসির একটি জরুরি বৈঠক ডাকে। সেখানে কাশ্মীর ইস্যুতে রাষ্ট্রসঙ্ঘ যেন হস্তক্ষেপ করে সেরকম একটি প্রস্তাব পাশ করানো হয়। কাশ্মীর সংক্রান্ত একটি গ্রুপও তৈরি করা হয়। যার মধ্যে পাকিস্তান, তুরস্ক, সৌদি আরব, নাইজিরিয়ার প্রতিনিধিরা ছিলেন। মোদি জমানায়, ২০১৯ সালে আবুধাবিতে ওআইসির ৪৬তম বিদেশমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ভারতকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে ভারতের প্রবেশ ঠেকাতে পাকিস্তান অনেক বিরোধ করে। তা সত্ত্বেও এই বৈঠকে ভারতকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয়। ২০০৬ সালে সৌদি আরবের রাজা আবদুল্লা নিজেই বলেছিলেন যে, রাশিয়ার মতো ভারতের ওআইসি-তে পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকা উচিত। ২০১৯ সালের ওআইসির বিদেশ মন্ত্রকের বৈঠকে তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী প্রয়াত সুষমা স্বরাজের উপস্থিতি সেখানে পাকিস্তানের প্রভাবকে যথেষ্ট হ্রাস করেছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহলের একাংশ। এরই মধ্যে বারবার ওআইসির প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যুতে সর্বদাই ওআইসিকে কাজে লাগাতে চেয়েছে। তবে ২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা বিলোপ সাধনের পরে ওআইসির (OIC) তরফ থেকে খুবই সংক্ষিপ্ত এবং হালকা বিবৃতি দেওয়া হয়। তখনই বোঝা যায় যে এদের প্রাসঙ্গিকতা ও ক্ষমতা, ঠিক কতটা!
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।