১৯৭১ সালের ২০ মে, বাংলাদেশের চুকনগরে পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে হাজার হাজার হিন্দুকে, জানুন সেই ইতিহাস
চুকনগর গণহত্যার স্মৃতিসৌধ (সংগৃহীত ছবি)
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: চুকনগর (Chuknagar Massacre) হল বর্তমান বাংলাদেশের খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার একটি ছোট্ট গ্রাম। ১৯৭১ সালের ২০ মে এখানে ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। সে ইতিহাস প্রায় বিস্মৃত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্য এবং রাজাকারদের দ্বারা যে গণহত্যা সংঘটিত হয় তা সারা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গণহত্যা হিসেবে গণ্য হয়। গণহত্যার বলি সব থেকে বেশি হন হিন্দুরা। আনুমানিক ত্রিশ লক্ষ মানুষের জীবন হানি হয় এই গণহত্যায়। মনে করা হয়, দু লাখ থেকে চার লাখ পর্যন্ত মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়। প্রায় এক কোটি হিন্দু বাঙালি উদ্বাস্তু হন। এ ছাড়া জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণ সমেত অন্যান্য অত্যাচারও করা হয়। সেই রকম একটি গণহত্যা আজ থেকে ৫৩ বছর আগে সংঘটিত হয় চুকনগরে। হাজার হাজার হিন্দুকে নিধন করা হয়। পাকিস্তানি সৈন্য এবং রাজাকাররা সর্বদাই টার্গেট করত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিদের। এর বেশিরভাগটাই ছিল সেদেশের হিন্দু সংখ্যালঘু নাগরিকরা। এর পাশাপাশি ছিল আওয়ামী লিগের কর্মীরাও। পাকিস্তানি সৈন্যরা সে সময়ে প্রগতিশীল এবং দেশপ্রেমিক মুসলমানদেরকেও হিন্দু সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ভারতীয় সমর্থক হিসেবে বিবেচনা করত। তাদের ওপরেও নেমে আসত অত্যাচার।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচার চরমে পৌঁছায়। সে সময় সে দেশে থাকা রাজাকাররাও পাকিস্তানি সৈন্যদের সাহায্য করতে থাকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী শুরু করে অপারেশন সার্চলাইট। এ সময় ঢাকায় নিরীহ নাগরিকদের ওপর চরম অত্যাচার চলতে থাকে। ভেঙে ফেলা হয় রমনা কালী মন্দিরকে।
সে সময় চুকনগর ছিল একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচারের দিনগুলিতে এই গ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ তা ছিল ভারতীয় সীমান্তের কাছে। সহজেই এই গ্রাম হয়ে ভারতে পৌঁছানো যেত। ভদ্রা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে খুলনা, বাগেরহাট, যশোর বরিশাল, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলা থেকে ভীত এবং আতঙ্কিত হিন্দুরা চুকনগর হয়ে ভারতের শরণার্থী শিবিরে পালাতে থাকে। তাঁরা বিভিন্নভাবে নৌকায়, পায়ে হেঁটে এবং গরুর গাড়িতে চড়ে চুকনগরের আশেপাশে আশ্রয় নিতে থাকে। যাতে তারা সহজেই ভারতে চলে আসতে পারে। চুকনগরকে (Chuknagar Massacre) কেন্দ্র করে অসংখ্য বাংলাদেশী নাগরিক যে ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে তা পাকিস্তানি সৈন্যদের কানে পৌঁছায়। জানা যায়, তৎকালীন বাংলাদেশের মুসলিম লীগের নেতা গোলাম হোসেন হিন্দুদের এই জমায়েতের খবর তৎকালীন সাতক্ষীরা জেলার পাকিস্তানি সৈন্যদের দিয়ে দেয়।
১৯৭১ সালের ১৯ মে সন্ধ্যা থেকে ২০ মে সকাল পর্যন্ত প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার পুরুষ মহিলা এবং শিশু সেখানকার বিভিন্ন স্কুল, মন্দির ও বিভিন্ন জনের বাড়িতে আশ্রয় নিতে থাকে। যারা আশ্রয়ের জায়গা পায়নি তারা খোলা ধান ক্ষেতে রাত কাটায়। এরপরেই ২০ মে সকাল দশটা নাগাদ ৩টি ট্রাক ভরতি পাকিস্তানি সৈন্য চুকনগর (Chuknagar Massacre) বাজারে হাজির হয়। তাদের সঙ্গে ছিল মেশিনগান এবং স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। স্থানীয় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্যদের পথ চিনিয়ে দিতে থাকে। স্থানীয়দের মুখ ঢাকা ছিল কাপড়ে, যাতে তাদেরকে সহজে কেউ চিনতে না পারে। পাকিস্তানি সৈন্যদের তিনটি ট্রাক চুকনগর বাজারে ঢুকতেই হিন্দু শরণার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে পাক সেনারা। গুলি চালাতে চালাতে তারা ভারতীয় সীমান্তের দিকে অগ্রসর হয়। সে সময় গুলি চালানোর প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসেন স্থানীয় কৃষক যার নাম ছিল চিকন আলি। তাঁকেও গুলি করে হত্যা করে পাক সেনারা।
২০ মে সারাদিনব্যাপী চলতে থাকে হত্যাযজ্ঞ। ধানের ক্ষেতে বাড়ি বাড়ি ঢুকে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি চালাতে থাকে পাকিস্তানি সৈন্যরা। এই গণহত্যা শেষ হওয়ার পরে স্থানীয় গ্রামবাসীদের উঠোনে, স্কুলে, মন্দির প্রাঙ্গণে, ভদ্রা নদীতে, খোলা নৌকায়, ধানের ক্ষেতে মৃতদেহ সারিবদ্ধভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায়। যারা প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তাদেরকেও পিছন থেকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। ভদ্রা নদীতে কেউ কেউ সাঁতার কেটে নিরাপদে যাওয়ার চেষ্টা করলেও বাঁচতে পারেনি তাঁরা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, চুকনগরে ১৯৭১ সালের ২০ মে আনুমানিক প্রায় দশ থেকে বারো হাজার গরিব শরণার্থী নিহত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। এত অল্প সময়ের (Chuknagar Massacre) মধ্যে এত বড় গণহত্যা সাম্প্রতিক অতীতে সত্যিই বেনজির।
ভদ্রা নদীতে সেদিন ভাসতে থাকে লাশ (Chuknagar Massacre)। সারাদিনব্যাপী গণহত্যা চালিয়ে সন্ধ্যার পরে ফিরে যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা । আশেপাশের গ্রামের মানুষজনেরা জমায়েত হন এবং প্রত্যেকে সাধ্যমত লাশ উদ্ধার করতে থাকেন। আজ থেকে ৫৩ বছর আগে সংঘটিত এই মর্মান্তিক গণহত্যা আজ বিস্মৃতিতে চলে গিয়েছে। স্থানীয় কিছু সংগঠন এবং ব্যক্তি এই গণহত্যার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। বর্তমানে বেশ কিছু উৎসাহী মানুষ চুকনগর গণহত্যা নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন এবং বেশ কিছু তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে এটির উপরে।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।