মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: ভারতবর্ষে সর্প পুজো একটি প্রাচীন অনুষ্ঠান। মনসা সাপের দেবী। তিনি মূলত লৌকিক দেবী। পরবর্তীকালে পৌরাণিক দেবী রূপে স্বীকৃত হন। শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের প্রতিটি ঘরে ঘরে মনসা দেবীর পুজো অনুষ্ঠিত হয়।
অনেকের মতে, সাপের কামড় থেকে রক্ষা পেতে মাটির সরায় দুধ-কলা দিয়ে দেবী মনসাকে পুজো করা হয়। সারাদিন উপোস করে পুজো শেষে সাবু-দুধ-কলা দিয়ে মনসার পুজো সম্পন্ন করে তবে উপবাস ভাঙেন মহিলারা। সমাজে এই পুজোর প্রচলিত হওয়ার জন্য রয়েছে প্রচলিত পুরাণ কাহিনি।
মনসা দেবীর মাহাত্ম্য
পুরাণ অনুসারে, মনসার হলেন শিবের স্বীকৃতকন্যা ও জরৎকারুর পত্নী। জরৎকারু মনসাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মনসার মা চণ্ডী (শিবের স্ত্রী পার্বতী) তাঁকে ঘৃণা করতেন কিন্তু পরবর্তীতে মাতা চণ্ডী মনসাকে নিজের মেয়ের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। কোনও কোনও ধর্মগ্রন্থে বলা আছে যে শিব নয়, ঋষি কাশ্যপ হলেন মনসার পিতা। মনসাকে ভক্তবৎসল বলে বর্ণনা করা হলেও, যিনি তাঁর পুজো করতে অস্বীকার করেন, তাঁর প্রতি তিনি নির্দয় হয়ে থাকেন।
মনসার উৎপত্তি বিষয়ে নানা কাহিনি শোনা যায়। সর্পদংশনের ভয় থেকে মানুষের পরিত্রাণের জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা কশ্যপমুনিকে একটি মন্ত্র বা বিদ্যাবিশেষ আবিষ্কার করার আদেশ দেন। ব্রহ্মার আদেশ পেয়ে কশ্যপ যখন মনে মনে এই বিষয়ে চিন্তা করছিলেন, তখন তাঁর মননক্রিয়া থেকে আবির্ভূত হন এক স্বর্ণবর্ণা দেবী। যেহেতু তিনি মানসজাতা, মন থেকে তাঁর জন্ম, তাই তিনি 'মনসা'। এই দেবী 'কামরূপা', অর্থাৎ ইচ্ছানুযায়ী রূপধারণ ও রূপপরিবর্তন করতে পারেন।
মনসা পুজোর প্রতিমাতেও পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। সিজ বৃক্ষের শাখায়, ঘটে বা সর্প-অঙ্কিত ঝাঁপিতে মনসার পুজো হয়। তবে কেউ কেউ মনসা প্রতিমা বানিয়ে পুজো করে থাকে। আবার কেউ কেউ পঞ্চ সর্পের ফণা যুক্ত প্রতিমার পুজো করেন। গোত্র ও অঞ্চল ভেদে প্রথার ওপর ভিত্তি করে মনসা দেবী বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রূপে তার ভক্তদের দ্বারা পূজিত হয়ে থাকেন। সরস্বতীর মতো দেবী মনসার বাহনও হংস। বাহনকে দেখেই আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে মনসাও জ্ঞানযুতা, জ্ঞানলক্ষণা। মনসার ১২টি নাম আছে। এগুলি হল— জরৎকারু, জগদেগৌরি, মনসা, সিদ্ধ যোগিনী, বৈষ্ণবী, নাগ ভগিনী, শৈবী, নাগেশ্বরী, জরৎকারু-প্রিয়া, আস্তিক-মাতা, বিষহরী, মহাজ্ঞানযুতা।
মনসা পুজোর তাৎপর্য
বাংলা অঞ্চলেই মনসার পুজো সর্বাধিক জনপ্রিয়। এই অঞ্চলে অনেক মন্দিরেও বিধিপূর্বক মনসার পুজো হয়। বর্ষাকালে যখন সাপের উপদ্রব বৃদ্ধি পায়, তখন মনসার পুজো মহাসমারোহে হয়ে থাকে। নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের কাছে মনসা একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন দেবতা। তাঁরা বিবাহের সময় ও সন্তানকামনায় মনসার পুজো করেন।
আষাঢ় মাসের পূর্ণিমার পর যে পঞ্চমী তিথি (শ্রাবণ) তাকে নাগপঞ্চমী বলে। নাগপঞ্চমীতে উঠানে সিজ গাছ স্থাপন করে মনসা পুজো করা হয়। ভাদ্রমাসের কৃষ্ণা পঞ্চমী পর্যন্ত পুজো করার বিধান আছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে একমাস যাবত্ পুজো করা হয়। শুধুমাত্র শেষ দিনে পুরোহিত দ্বারা পুজো করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে পুরো শ্রাবণ মাস মনসা পুজো হয়। পুজো উপলক্ষে হয় পালাগান ‘সয়লা’। এই পালার বিষয় হল — পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গল। সারা রাত ধরে গায়ক দোয়ারপি -সহ পালা আকারে ‘সয়লা’ গান গায়। পুরুলিয়ায় মনসা পুজোয় হাঁস বলি দেওয়া হয়। রাঢ়বঙ্গ বাঁকুড়ায় জ্যেষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের দশমী তিথিতে দশহরা ব্রত পালন করে মনসা পুজো করা হয়। তখন এখানে ঘুড়ি ওড়ানো হয়।
মনসা পুজার অঙ্গ হল অরন্ধন। রাঢ়ে চৈতন্য দেবের সময়ে মনসাকে মা দূর্গার এক রূপ মনে করা হত। তাই কোনও কোনও জায়গায় পুজোয় বলি দেওয়া হত। আজও অনেক পুজোয় পাঁঠা বলি হয়।
২০২২ সালের মনসা পুজোর দিন-তারিখ
মা মনসা পুজো পড়েছে শ্রাবণ মাসের শেষ দিন অর্থাৎ, বুধবার ১৭ অগাস্ট।
মনসা পুজোর উপকরণ:
সিঁদুর, ঘট, মনসা গাছ বা তাহার ডাল, পুজোর শাড়ি ১, মধুপর্কের বাটি ১, দুধ, মধু, ঘৃত, দধি, তিল, হরিতকি, পুষ্প, দূর্বা, তুলসী, বিল্বপত্র, ধূপ, দীপ, বড় নৈবেদ্য ১, অষ্টনাগের নৈবেদ্য ৮, কুচা নৈবেদ্য ১, উচ্ছে, ফল।
+ There are no comments
Add yours