বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রবর্তক হিসাবে শশাঙ্কের স্বপক্ষেই যুক্তির পাল্লাই ভারী
প্রতীকী ছবি
জিষ্ণু বসু
আমাদের বাংলা ক্যালেন্ডারের সঙ্গে মাসের দিনসংখ্যা অনেকটাই আলাদা বাংলাদেশে। কেন এই পার্থক্য? দেশভাগের আগে তো একটাই বাংলা ছিল। এই বঙ্গভূমিতে কোন বর্ষপঞ্জি অনুসৃত হতো? ঢাকার দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ আর কলকাতার স্যার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কি আলাদা পয়লা বৈশাখ মানতেন? সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল কোন বর্ষপঞ্জি মেনে নববর্ষ পালন করতেন?
প্রাচীনকাল থেকে বাংলার মাটিতে চলে আসা এই যে চান্দ্র-সৌর বর্ষপঞ্জি তার শুরুটাই বা কোথায়? স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে আজ থেকে ১৪৩০ বছর আগেই বঙ্গাব্দের যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও বিতর্ক আছে। অনেকেই এখন বলছেন, ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দকে শুরু ধরে সম্রাট আকবর কর্তৃক এই বঙ্গাব্দ চালু হয়েছিল।
বাংলা মাসের দিন পালটানো বা সূচনা কাল নিয়ে বিতর্ক বড় করে উঠে এল গত শতাব্দীর ছ’য়ের দশকে। ১৯৬৪ সালে সারা বাংলাদেশ জুড়ে ভয়ানক দাঙ্গা হল। সেদেশ থেকে হিন্দুদের বিতাড়ন মানে 'এথনিক ক্লিনসিং' শুরু হল পাকিস্তান সরকারের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু মানুষ তাড়ালেই তো শুধু হবে না, পূর্ব পাকিস্তান তো একটা গোটা স্বতন্ত্র সংস্কৃতি। হিন্দুর পরম্পরাকে বাদ দিলে তো তার অর্ধেকের বেশিটাই খালি হয়ে যাবে। এই সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে বাংলা বর্ষপঞ্জি যার ভিত্তিটা সূর্যসিদ্ধান্তের উপরে স্থাপিত।
বাংলা বর্ষপঞ্জি পরিবর্তনের জন্য পাকিস্তানের তদানীন্তন সরকার একটি কমিটি তৈরি করেছিল। যার প্রধান ছিলেন মহম্মদ শহিদুল্লাহ। ১৯৬৬ সালে শহিদুল্লাহ সাহেবের কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। কমিটির সুপারিশ অনুসারে বাংলার প্রথম পাঁচটি মাস ৩১ দিন হবে ঠিক হল, আর বাকি মাসগুলি ৩০ দিনের। লিপ-ইয়ার হলে ফাল্গুন মাস ৩১ দিন ধরে নেওয়া হবে। যেহেতু তিথি নক্ষত্রের হিসাব রাখতে হবে না তাই প্রতি বছরই ১৪ এপ্রিল তারিখে হবে পয়লা বৈশাখ। এই রিপোর্টেই ৪ নম্বর পয়েন্ট হিসাবে উল্লেখ ছিল যে বঙ্গাব্দের সূচনা করেছিলেন সম্রাট আকবর খ্রিস্টীয় ১৫৮৪ সালে। তারও ২৯ বছর আগে মানে তাঁর মসনদে বসার সাল ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ ৯৬৩ হিজরি সালকে বঙ্গাব্দের শুরু হিসেবে ঘোষণা করেন।
পাকিস্তান সরকারের এই রিপোর্ট নিয়ে বিতর্কের বিস্তর অবকাশ আছে। ১৪ এপ্রিলকেই পয়লা বৈশাখের দিন স্থির করা এককথায় অবৈজ্ঞানিক। সূর্যসিদ্ধান্ত মতে, বছরের দিনসংখ্যা ৩৬৫.২৫৮৭৫৬ আর গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার হিসাবে ৩৬৫.২৪২২ দিন। মানে পার্থক্য হল ০.০১৬৫৫৬ দিন। শহিদুল্লাহ সাহেব যখন রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন সেদিন থেকে আজকের মধ্যেই প্রায় একদিনের (০.৮৯৪ দিনের) পার্থক্য হয়ে গিয়েছে।
বছরের প্রথম পাঁচ মাস ৩১ দিনের হিসেবটাও সমীচীন নয়। ভারতীয় বর্ষপঞ্জির অন্যতম বিশেষত্ব হল নক্ষত্রের অবস্থান। মাসেদের নামও এর সঙ্গে সম্পর্কিত। বঙ্গাব্দের শুরুর বছর মানে ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে ভার্নাল ইক্যুইনক্স বা মহাবিষুবের দিন ছিল ২০ মার্চ। ঠিক তার পরেই ২৭ মার্চ ছিল অমাবস্যা। বঙ্গাব্দের প্রথম অমাবস্যার দিন রেবতী নক্ষত্র, সূর্য, চন্দ্র ও পৃথিবী ঠিক এক সরলরেখায় ছিল। রেবতীকে আদি নক্ষত্র ধরেই বঙ্গাব্দের মাসের রচনা। কিছু মাসকে ইচ্ছেমতো ৩১ দিন ধরে নিলে বঙ্গদেশের পণ্ডিত মানুষদের এতশত বছরের সাধনার ধনকে জলাঞ্জলি দেওয়া হবে।
শহিদুল্লাহ কমিটি বলেছিলেন, সম্রাট আকবর ১৫৮৫ সালে বঙ্গাব্দ শুরু করেন। আকবর তাঁর জ্যোতির্বিদ ফতল্লাহ শিরাজিকে হিজরি সালের সঙ্গে সূর্য সিদ্ধান্তের বর্ষগণনার হিসাব মিলিয়ে বর্ষপঞ্জি রচনার কথা বলেন। তখন আকবরের রাজত্বের ২৯ বছর হয়ে গেছে। তাই তাঁর মসনদে বসার বছর অর্থাৎ ১৫৫৬ সাল বা ৯৬৩ হিজরিকে প্রথম বঙ্গাব্দ ধরতে বলেন। এরপর থেকে সৌরবর্ষ যোগ করলে বঙ্গাব্দ পাওয়া যায়। যেমন ২০২০ খ্রিস্টাব্দ মানে ৯৬৩ + (২০২০- ১৫৫৬) = ১৪২৭ বঙ্গাব্দ।
এই মিলিয়ে দেওয়া নিয়েও অনেকে আপত্তি করেছেন। বিজ্ঞানী পলাশবরন পাল তাঁর 'সাল তারিখের ইতিহাস' বইতে একটি সরল যুক্তি দিয়েছেন। আকবর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ১৫৮৫ সালে, তাহলে সিদ্ধান্ত তখন থেকে কার্যকরী করাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দ মানে ৯৯৩ হিজরি, সেক্ষেত্রে আর উপরের ম্যাজিক সমীকরণ মিলবে না।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আজকের যুগে আকবরের রাজত্বের ২৯ বছর বাদ দেওয়া সহজ, কিন্তু আকবরের দরবারও চলত হিজরি সাল হিসাবে। হিজরি সাল হিসাবে ১২টি ২৯.৫ দিনের চন্দ্রমাসের যোগফল মানে ৩৫৪ দিনে বছর। তাই দু'টি সময়ের ব্যাবধান হিজরি সাল গণনা হিসাবে ৩০ বছরের কিছু বেশি। ফতল্লাহ শিরাজি বাদ দিলে ৩০ বিয়োগ করতেন ২৯ কখনওই নয়। তাই বাদ দিয়ে অঙ্ক মেলানোর প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে আধুনিক।
তাছাড়া আকবরের জীবদ্দশায় মোগলরা বাংলায় রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে উঠে আসেনি। ১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে মোগলদের কাছে বাংলার আফগান শাসক দাউদ খান করর্নি পরাজিত হন। কিন্তু তারপরেও লাগাতার যুদ্ধ চলে। জাহাঙ্গিরের শাসনকাল পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলেছে। তাই ১৫৮৫ সালে সারা বাংলাতে শান্তিতে রাজত্ব করার অবস্থা বাদশা আকবরের ছিল না। তখন মোগল রাজত্ব কাবুল, মুলতান থেকে পূর্বে পাটনা পর্যন্ত মোট ১২টি সুবায় ভাগ ছিল। সম্রাট আকবর বেছে বেছে আপাত অস্থির বাংলাতেই তাঁর অব্দ শুরু করলেন কেন? স্বাভাবিক যুক্তিবোধে এর সঠিক উত্তর মেলে না।
আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরিতে বঙ্গাব্দ বা বাংলায় বিশেষ সন প্রবর্তনের কোনও উল্লেখ নেই। বিভিন্ন বিষয় আলোচনার সময়ে অনেক সাল তামামি আছে কিন্তু বাংলা অব্দ নিয়ে একটি শব্দও নেই। হিজরি সাল হিসাবে ভারতবর্ষের ফসলের কর আদায়ের অসুবিধে হচ্ছে, তাই ফতল্লাহ শিরাজিকে তারিখ-ই-ইলাহি তৈরি করতে বলেছিলেন সম্রাট। এরকম হতেই পারে যে বাংলায় প্রচলিত বর্ষপঞ্জিকে দেখে এমনই একটা চান্দ্র-সৌর অব্দ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু শস্যশ্যামলা বঙ্গদেশে এটি ফসলের কালের সঙ্গে মিলত, কাবুলে বা মুলতানে নিশ্চয়ই মিলত না। তাই আকবরের ইন্তেকালের সঙ্গে সঙ্গেই দ্বীন-ই-ইলাহির মত তারিখ-ই-ইলাহিও হারিয়ে যায়।
কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় 'বঙ্গ আমার জননী আমার' কবিতায় যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের কথা বলেছেন। ‘যুদ্ধ করিল প্রতাপাদিত্য তুই কি না সেই ধন্য দেশ’, এই প্রতাপাদিত্য মোগলদের সঙ্গেই যুদ্ধ করেছিলেন। ১৫৮৪ সালে তিনিও রাজ্যপাট হাতে পান। তিনি যশোরে শিক্ষাবিস্তারের জন্য জেস্যুইট মিশনারিদের গির্জা বানাতে দিয়েছিলেন। তাঁর নৌবহরে পর্তুগিজ কুশল কারিগর ছিলেন। অর্থাৎ এক স্পন্দনশীল বাংলা সেদিন দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ছিল, রাজমহল জয় করেই বঙ্গাব্দ প্রচলনের প্রশ্নই ওঠে না।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে ‘ক্যালেন্ডার রিফর্ম কমিটি’ গঠিত হয়েছিল। অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা এই কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন। এই কমিটির সুপারিশ অনুসারেই 'শালিবাহন শক' বর্ষপঞ্জিকে ভারতবর্ষের জাতীয় বর্ষপঞ্জি হিসাবে গ্রহণ করা হয়। ১৯৫৫ সালে এই কমিটির পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এই কমিটি দেখেছিল যে ভারতীয় কালগণনা পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত। আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের পরে গ্রিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা হলেও গ্রিক জ্যোতির্বিদ্যা থেকে ভারতের কিছু নেওয়ার ছিল না।
বাংলার সাল গণনার বিষয়েও এখানে আলোকপাত করা হয়েছে। চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকের শুরুর সময় পর্যন্ত বাংলা মূলত গুপ্ত সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। তারপর ৭৫০ থেকে ১১৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাল রাজারা শাসন করেন। সেন রাজারা কর্ণাটকের ক্ষত্রিয় ছিলেন। তাঁরাই বাংলায় শকাব্দ সাল গণনা রীতি নিয়ে আসেন। মুসলমান শাসনের সময় নবাব দরবারে হিজরি সাল চলত। কিন্তু শিক্ষিত সমাজে “শক” বর্ষপঞ্জিই ব্যবহৃত হতো। বাংলার সাধারণ মানুষ 'পরগনাতি অব্দ' নামে একটি বর্ষপঞ্জি মানতেন। তারিখ-ই-ইলাহির পরে থেকে নবাব দরবারেও সূর্যসিদ্ধান্তই মানা হতো।
গুপ্তযুগের পরে এবং পালযুগের আগে ছোট সামন্ত রাজারা রাজত্ব করেছেন। হর্ষচরিতে মৌখরি বংশের প্রতিনিধি শশাঙ্কের বর্ণনা আছে। কামরূপ-বিজয়ী এই শশাঙ্কের রাজধানী ছিল অধুনা মুর্শিদাবাদের কাছে কর্ণসুবর্ণতে। আজ থেকে ১৪৩০ বছর আগে শশাঙ্কই গৌড়ের রাজা ছিলেন। তাই বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রবর্তক হিসাবে শশাঙ্কের সপক্ষেই যুক্তির পাল্লাই ভারী। তবে নিশ্চয় তখন একে বঙ্গাব্দ বলা হতো না। কিন্তু, বাংলা সাল গণনা তখন থেকেই শুরু।
নীতীশকুমার সেনগুপ্ত ১৯৫৭ সালের ব্যাচে বেঙ্গল ক্যাডারের আইএএস। দুই বাংলার প্রতি টান থেকে একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ লিখেছেন তিনি, 'ল্যান্ড অফ টু রিভার্স: এ হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল ফ্রম দ্য মহাভারত টু মুজিব।' লেখক দেখিয়েছেন বাঁকুড়ার ডিহারগ্রাম ও সোনাতপনে হাজার বছরের প্রাচীন শিব মন্দিরে বাংলা অব্দের উল্লেখ আছে।
মেঘনা গুহঠাকুরতা ও উইলিয়ম ভ্যান শেন্ডোলের বই ‘দ্য বাংলাদেশ রিডার: হিস্ট্রি, কালচার, পলিটিক্স’ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে। বইটিতে বাংলার বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের কৃতিত্ব গৌড়েশ্বর শশাঙ্ককেই দেওয়া হয়েছে।
বঙ্গাব্দ নিয়ে বিস্তর গবেষণার সুযোগ আছে। বাঙালি বুদ্ধিমান, বাঙালি যুক্তিবাদী সেইসঙ্গে বাঙালির ছোঁয়া বিশ্বজুড়ে। তাই যে মতটা যুক্তিগ্রাহ্য এবং বিজ্ঞানভিত্তিক সেটিকেই মানবে আধুনিক বাঙালি। কিন্তু আরগুমেনটেটিভ তর্কবাগীশ বাঙালিও অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যুক্তিবোধের থেকে আর্ষপ্রয়োগকেই বেশি মেনে নেয়। সমস্যাটা সেখানেই।
(লেখক কলকাতার সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এ কর্মরত)
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook, Twitter এবং Google News পেজ।
Tags: