মাধ্য়ম নিউজ ডেস্ক: একটা সময় ছিল যখন বিরাট কোহলি ক্রিকেটের বাইশ গজে রাজত্ব করতেন এবং কেউ তাঁর ফর্মের ধারে কাছেও পৌঁছতে পারতেন না। অন্যান্য ব্যাটাররা তখন বিরাটের থেকে কয়েক হাজার মাইল পিছনে থাকতেন। বোলারদের কাছে তখন বিরাট কোহলিকে বল করা দুঃস্বপ্নের সামিল ছিল। এমনকী, বিশ্বের সেরা বোলারদেরও কোনওরকম রেয়াত করতেন না তিনি।
এতটাই ছিল তাঁর আধিপত্য, ক্রিকেট দুনিয়ায় তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিলে 'কিং কোহলি'। কোনও কথার কথা নয়। বিরাটের চওড়া ব্যাট থেকে এসেছে একের পর এক দৃষ্টান্তকারী ইনিংস। একাধিক রেকর্ড ভেঙেছেন এবং গড়েছেন। এমনকী, বলা হচ্ছিল যে, সচিন তেন্ডুলকরের রেকর্ড যদি কেউ ভাঙতে পারেন, তা করে দেখাতে পারেন শুধু একমাত্র বিরাটই।
কিন্তু, ২০১৯ সাল থেকে বিরাট-ফর্মে ছন্দপতন ঘটতে শুরু করে। যত সময় গড়িয়েছে, বিরাটের 'ব্যাড প্যাচ' খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে। প্রায় তিন বছর হতে চলল। বর্তমানে ছন্দের ধারেকাছে নেই বিরাট। একদা বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটারের ফর্ম তাঁর কেরিয়ারের তলানিতে এসে ঠেকেছে। যে বিরাটের ছোঁয়ায় সবকিছুই সোনায় পরিণত হত, এখন পুরোটাই তা উল্টোস্রোতে বইছে।
তারকা ব্যাটারের এই খারাপ ফর্মে ভীষণই চিন্তিত তাঁর ভক্তরা। এমনিতেই, ভক্তদের প্রত্যাশার চাপ যে কোনও খেলোয়াড়ের ওপরই থাকে। সচিন তেন্ডুলকর থেকে সৌরভ গাঙ্গুলি-- সকলেই ভক্ত-অনুরাগীদের প্রত্যাশার চাপ অনুভব করেছেন। কিন্তু, বিরাটের এই দুঃসময় যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, ততই অস্থির হচ্ছেন তাঁর অনুরাগীরা। কেউ কেউ তো এমনও বলতে শুরু করেছেন যে, বিরাটের স্বর্ণযুগ শেষ। তিনি আর সেই ফর্ম ফেরত পাবেন না। অনেকের ধারণা, তিনি মানসিকভাবে যে কাল্পনিক নির্বাসনে গিয়েছেন সেখান থেকে ফিরে আসছেন না।
এটা নয় যে, বিরাট নিজে চিন্তিত নন, বা তিনি নিজের ফর্মে ফেরার চেষ্টা করছেন না। নিজের পুরনো মেজাজ ফিরে পেতে কোনও কসুর রাখছেন না প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক। কিন্তু, কোথাও কোনওকিছুই যেন ঠিকঠাক হচ্ছে না। কিছু একটা ক্লিক করছে না। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পড়েছে, যে নিজের খারাপ ফর্ম দেখে নিজের প্রতি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ফেলছেন কোহলি। মনে মনে হয়ত ভাবছেন, খারাপ সময় কাটিয়ে ওঠার জন্য আর কী কী করা যেতে পারে!
তবে, বিরাট-পতনের কারণ কী হতে পারে? অন্তত সাধারণ চোখে তিনটি সম্ভাব্য কারণের দেখা মিলছে, যা থেকে বোঝা যাবে, কেন কোহলি এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে বাঁধা পড়েছেন। প্রথম কারণ হতে পারে যে-- নিজের জন্য নয়, দর্শকদের জন্য খেলতে শুরু করেছেন বিরাট। কোভিড অতিমারীর সময়ে মাঠে দর্শক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা হওয়ার ফলে, অধিকাংশ ম্যাচই হয়েছে ফাঁকা স্টেডিয়ামে। দর্শকরা যে কোনও খেলোয়াড়ের অনুপ্ররেণা। কোহলিও ব্যতিক্রমী নন। হতে পারে, কোথাও গিয়ে দর্শকহীনতা তাঁর ফর্মে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।
এখন দর্শক আসতে শুরু করেছেন। ফলে, হতে পারে, দর্শকদের মনোরঞ্জনের কথা মাথায় ঘুরছে বিরাটের। আগে কোহলির ব্যাটিং দেখে মনে হত, তিনি নিজে উপভোগ করছেন। এখন দেখে মনে হয়, তিনি দর্শকদের জন্য কিছু করতে চাইছেন, নিজের জন্য নয়। আর এখান থেকেই হয়ত তাঁর মনে কোনও ভীতি তৈরি হয়েছে। না হলে, যে মানুষটা ইচ্ছেমতো বোলারদের সংহার করতেন, এখন কেমন একটা যেন কুঁকড়ে গিয়েছেন। যে মানুষটার সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল তাঁর আত্মবিশ্বাস, তা এখন অনুপস্থিত।
দ্বিতীয়ত, বিরাটের টাইমিং একেবারেই চোখে পড়ছে না। বিরাট চিরকাল ক্রিকেটীয় শট খেলার জন্য পরিচিত। তাতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তাঁর নিখুঁত টাইমিং। যে কোনও বলের লাইন-লেংথ বিচার করতে বিশ্ব ক্রিকেটে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু, বর্তমানে সেটাই যেন হারিয়ে গিয়েছে। অধিকাংশ আউট হচ্ছেন টাইমিংয়ের গণ্ডগোলে। হয় কখনও আগে খেলছেন, কখনও বা দেরিতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে আউট হচ্ছেন। কারণ, তিনি বলের লাইন-লেংথ বিচার করতে পারছেন না।
তৃতীয়ত, বিরাটকে দেখে মনে হচ্ছে, নিজের ফর্ম নিয়ে তিনি ক্লান্ত। তা তাঁর বডি ল্যাঙ্গোয়েজে স্পষ্ট। একজন ক্রীড়াবিদের ক্ষেত্রে তাঁর বডি ল্যাঙ্গোয়েজ বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। বিরাটের জন্য এটা বড় ফ্যাক্টর। কারণ, বিরাটের লাফল্যের অন্যতম মূল উপাদান হল তাঁর আত্মবিশ্বাস। এখন সেই আত্মবিশ্বাসটাই ধাক্কা খেয়েছে। যা তাঁর বডি ল্যাঙ্গোয়েজে প্রকাশ পাচ্ছে। এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে একমাত্র বিরাটই পারেন। তাঁর ওপর সেই বিশ্বাস রেখেছেন তাঁর লক্ষ লক্ষ ভক্তরা। সকলে চাইছেন, 'কিং কোহলি'-কে দেখতে। এখন বিরাটকে তাঁর নিজের ক্ষমতায় বিশ্বাস করতে হবে।
+ There are no comments
Add yours