Great Bengal Cyclone: ১৭৩৭ সালের ১১ অক্টোবর কলকাতায় কী হয়েছিল জানেন?
কলকাতায় 'গ্রেট বেঙ্গল সাইক্লোনের' দৃশ্য (সংগৃহীত ছবি)
হরিহর ঘোষাল
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: ইদানীং ঝড়ের নামকরণ করার বিধি হয়েছে। সেই হিসেবে প্রতিটি ঝড় নিয়েই আগাম চর্চার পরিসর অনেকটা খুলে যায়। সেই চর্চার সূত্রেই কলকাতার (1737 Calcutta Cyclone) প্রথম সাইক্লোন বা উঠে আসছে 'গ্রেট বেঙ্গল সাইক্লোনের' (Great Bengal Cyclone) প্রসঙ্গ। সেই ঝড়ের বিধ্বংসী শক্তি নিয়ে আজও মানুষ কৌতূহলী। এখনও পর্যন্ত এই ঝড়টিকেই বাংলার নথিভুক্ত প্রথম ভয়াবহ ঝড় বলা যায়!
২৮৭ বছর আগের কথা। তখনও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কব্জায় আসেনি ভারত। ১৭৩৭ সালের ১১ অক্টোবর। আজকের দিনেই ভয়ঙ্কর এক সাইক্লোনের পাল্লায় পড়েছিল বাংলা। বিধ্বস্ত হয়ে গেল কলকাতা। শুধু ঝড় নয়, সেসময়ে ভূমিকম্পেও কেঁপে উঠেছিল বাংলা। 'গ্রেট বেঙ্গল সাইক্লোন' নামে পরিচিত এই ঝড়ের জেরে ভারত মহাসাগরে সুনামিও এসেছিল বলে জানা গিয়েছে। পলাশির যুদ্ধের কুড়ি বছর আগে, সাইক্লোন ও ভূমিকম্পের জোড়া আক্রমণে প্রায় ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল কলকাতা। মারা গিয়েছিলেন অন্ততপক্ষে ৩ লক্ষ মানুষ। জাহাজডুবির ঘটনাও পাওয়া গিয়েছে। ভেঙে পড়েছিল বহু বাড়ি, অট্টালিকা। প্রাকৃতিক বিপর্যের (1737 Calcutta Cyclone) চোটে সেদিন বহু ইটের বাড়িও মাটিতে মিশে গিয়েছিল! শহরের বুকে নৌকাডুবি। ট্রাম-বাস চলে না এ রাস্তা দিয়ে। সুতরাং ট্রাম-বাস অ্যাকসিডেন্ট নয়। স্বভাবতই রিকশা-ঠেলারও নয়। সুতরাং নৌকাডুবিই হয়েছিল এখানে। আজব নগরীতে সে এক তাজ্জব ব্যাপার।
১৬৮০ থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক জন আধিকারিক মোতায়েন ছিলেন কলকাতার কুঠি সামলানোর জন্য। সে রকমই এক জন আধিকারিক জন স্ট্যাকহাউস। তিনি কলকাতার দায়িত্বে ছিলেন ১৭৩২ থেকে ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দ অবধি। তাঁর আমলেই তৎকালীন বাংলা কেঁপে উঠেছিল ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে। ঐতিহাসিক নথিতে যার পরিচয় '১৭৩৭ বেঙ্গল সাইক্লোন' নামে। আজ থেকে ২৮৭ বছর আগে এই কলকাতা থেকে লেখা একখানা চিঠি উদ্ধার হয়েছে। সেদিনের সেই দুর্যোগের ঘটনার সাক্ষী ছিলেন সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্য স্যার ফ্রান্সিস রাসেল। তিনি সেদিন কলকাতাতেই ছিলেন। তাঁর চিঠিতে ঘটনার প্রত্যক্ষ বিবরণ ফুটে উঠেছে। চিঠিতে তিনি লেখেন, "এমন আতঙ্কের দৃশ্য (1737 Calcutta Cyclone) আর কোনও দিন দেখিনি আমি। এমনকী শুনিনি পর্যন্ত। যে বাড়িটায় আমি আছি, আমার বিশ্বাস, সেটা কলকাতার সব চেয়ে মজবুত বাড়ি। কিন্তু বৃষ্টি আর বাতাসের বেগ এমন তীব্র হয়েছিল সেদিন যে, প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল যেন ছাদটা ভেঙে পড়বে আমাদের মাথায়। এমন ভয়ানক শব্দ হচ্ছিল ওপরে যে, পরিবারের লোকজনকে নিয়ে অবশেষে আমাকে নেমে আসতে হল নীচে। সেখানে আবার আশ্রয় নিয়েছেন বেচারা মিসেস ওয়াস্টেল তাঁর ছেলেপুলে নিয়ে। ঝড়ের তোড়ে তাঁর বাড়ির জানালা-দরজা সব ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছে দেওয়ালের গা থেকে। সকাল অবধি আমাদেরও কাটাতে হল তাঁর সঙ্গে নীচে। অবশেষে সকাল হল। শহরটার দিকে তাকালে মনে হয় শত্রুপক্ষ এসে যেন বেপরোয়া বোমা বর্ষণ করে গেছে এর উপর। আমাদের সুন্দর ছায়াচ্ছন্ন রাস্তাগুলোর দু' ধারে একটিও গাছ নেই। সব ছিন্নভিন্ন। গতকাল যা ছিল, আগামী কুড়ি বছরেও তেমনটি হবে না আর। নদীটি রূপ নিয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রের। সারা নদী ধ্বংসস্তূপে বোঝাই।"
এ কে সেনশর্মার বই 'গ্রেট বেঙ্গল সাইক্লোন ১৭৩৭' তে আছে বিপর্যয়ের বিস্তারিত বিবরণ। সেই বিবরণ থেকে আঁচ পাওয়া যায় কতটা ভয়ঙ্কর ছিল সে রাতের জলোচ্ছ্বাস। গাঙ্গেয় বদ্বীপের ৬ লিগ অবধি উঠেছিল জলস্তর। ১ লিগ মানে সাড়ে পাঁচ কিমি। সেখান থেকে কিছুটা অনুমেয় কতটা বীভৎস ছিল জলের প্রাচীর। গাঙ্গেয় বদ্বীপ সংলগ্ন ৩৩০ কিমি এলাকা বিধ্বস্ত হয়েছিল ঝড়ের তাণ্ডবলীলায়। অর্থাৎ, আজকের প্রেক্ষিতে কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর অবধি প্লাবিত হয়েছিল। সাগরের বদ্বীপ অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছিল ৪০ ফিট অবধি। হিসেবমতো এই উচ্চতা আজকের চারতলা বাড়ির সমান। ৬ ঘণ্টা ধরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৩৮১ মিলিমিটার। প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় তিন লক্ষ মানুষ। ইংরেজদের তৈরি সেই আদি উপাসনাস্থল চুরমার হয়ে ভেঙে পড়েছিল। কয়েক টুকরো হয়ে গিয়েছিল কুমোরটুলির গোবিন্দরামের মন্দিরের মূল পঞ্চরত্ন চূড়া। দাপুটে গোবিন্দরাম ছিলেন সে কালের এক ধনকুবের। তার তৈরি মন্দিরের আর এক নাম ছিল 'ব্ল্যাক প্যাগোডা'। শোনা যায়, উচ্চতায় তা ছিল অক্টারলোনি সৌধের থেকেও দীর্ঘ। গঙ্গার তীব্র জলোচ্ছ্বাসে লন্ডভন্ড হয়ে যায় গঙ্গার ঘাটগুলি। দেশীয় ডিঙি নৌকোর পাশাপাশি উধাও বিদেশি বণিকদের জাহাজও। সেন্ট অ্যানের গির্জা নেই। কাঁচা কি পাকা বাড়ি সব মাঠ। পাঁচ টনের দু'খানা ইংরেজি জাহাজ নাকি ছিটকে পড়েছিল নদীর বুক থেকে দু'শ ফ্যাদম দূরে এক গ্রামের ভিতরে। চল্লিশ ফুট বেড়ে গিয়েছিল সেদিন হুগলি নদীর জল। সেদিন নিশ্চয়ই বন্যা হয়েছিল এই অঞ্চলে। চারিদিকে থই থই জল। ধানখেত ডুবে গিয়েছে। কলকাতা বিরাট বিরাট গাছগুলো সব বুক জলে দাঁড়িয়ে।
১৭৩৭ সালের (1737 Calcutta Cyclone) পর কলকাতার বুকে বার বার ঝড়় আঘাত করেছিল। জানা যায়, এরপর ১৭৮৭, ১৭৮৯,১৮২২, ১৮৩৩ সালে গাঙ্গেয় বঙ্গে বারবার হানা দেয় প্রাণঘাতী ঝড়। দশ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয় এই সব ঝড়ে। এরপর বাংলায় ঝড়ের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতি হয় ১৮৭৬ সালের দ্য গ্রেট বেঙ্গল সাইক্লোন বা কুখ্যাত বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন। এই ঝড়ের তাণ্ডবে প্রায় ২ লক্ষ মানুষ মারা যান। বাংলাদেশের সুন্দরবন উপকূলে আছড়ে পড়া এই ঝড়ের ধ্বংসলীলার জেরে ঢাকা শহরে লোক সমাগম এক ধাক্কায় লাফিয়ে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। এই সাইক্লোন মোকাবিলায় ইংরেজ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে পরবর্তী সময়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বার বার ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে তছনছ হয়েছিল বাংলা-সহ আজকের কলকাতা। বিদেশি ঔপনিবেশিকদের কলমে নথিবদ্ধ আছে সেই দু'দিনের ভয়াল অভিজ্ঞতা।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।