Kolkata: কলকাতায় এল বিদ্যুৎ! লন্ডনের পর প্রথম আলো জ্বলেছিল এই শহরে
কলকাতার রাস্তায় জ্বলছে আলো (সংগৃহীত ছবি)
হরিহর ঘোষাল
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: কলকাতার বুকে তখনও আলো (Electricity) আসেনি। লোডশেডিং-এর গল্প তখনও অজানা। তখন সন্ধ্যা নামতেই সর্বত্র অন্ধকার ঘুলঘুলি। রাস্তাগুলিতে আলোর লেশমাত্র থাকত না বিকেলের পর থেকে। ঊনিশ শতক শুরুর আগে শহরের রাস্তায় কোনও পথ-বাতি ছিল না। সন্ধ্যা নামলেই দরজা বন্ধ হত গৃহস্থের। কলকাতায় তখনও আলো ছিল না, আলো থাকলেও সন্ধ্যাবেলা শুধুমাত্র গৃহস্থের বাড়িতে রেড়ির বীজের তেলে প্রদীপ জ্বলত। পরে, শহরে এল গ্যাসবাতি। তারপর দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান, লন্ডনের পর কলকাতা শহরে জ্বলল আলো।
কলকাতার (Kolkata) রাস্তা জুড়ে তখন অন্ধকারের মালা। সন্ধ্যার অন্ধকার নামলেই সব যেন নিস্তব্ধ, নীরব। তা বলে কি রাতে কারোর বাইরে বেরোনোর দরকার পড়ত না? তখন উপায় কী হত! পাটকাঠির ওপর মশাল জ্বেলে নিতেন বাড়ির পুরুষ সদস্যরা। সাধারণত কেউ অসুস্থ হলে বা কেউ বিপদে পড়লে প্রয়োজন পড়ত এই মশালের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেকজন একসঙ্গে বের হতেন, নইলে মশাল হয়ে উঠত সন্দেহের কারণ।
কলকাতার আগে যে শহরের রাস্তায় আলো জ্বলে (Electricity) উঠেছিল, সেটা হল লন্ডন। ১৮০৭ সালে লন্ডনের রাস্তায় প্রথম গ্যাসবাতির আলো জ্বলে। ১৮২২ সালের ২২শে মার্চ একটি বাংলা দৈনিকে প্রথম লন্ডনের রাস্তায় আলো জ্বলার খবর প্রকাশিত হয়। সেখানে লেখা হয়-"ইংলণ্ড দেশে নল দ্বারা একপ্রকার কল তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে বায়ু নির্গত হয়ে রাত্রিকে আলোকিত করে।" দৈনিক পত্রিকাটির খবর কলকাতা শহরে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তবে, আলোড়নের ফলাফল পেতে সময় লেগেছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর। ১৮৫৭ সালের জুলাই মাসে কলকাতার রাস্তায় আলো আসে। সে আলো ছিল গ্যাসবাতির আলো। শোনা যায়, কলকাতা পুরসভার মুটে সন্ধ্যা হতে না হতেই মই নিয়ে ল্যাম্পপোস্টে উঠত, তারপর ভালো করে কাপড় দিয়ে মুছে গ্যাস ভরত, তারপর দেশলাই দিয়ে আলো জ্বালাত। রাস্তার ঝলমলে দিনের গল্প শুরু তখন থেকেই। আলো জ্বালাতে ব্যবহার করা হত কয়লার গ্যাস। সেই গ্যাস আসত ওরিয়েন্টাল গ্যাস কোম্পানি থেকে। পরে, পাইপলাইনের মাধ্যমে উচ্চবিত্তের বাড়িতেও পৌঁছে গিয়েছিল গ্যাসবাতি। আর এই যাত্রা শুরু হয়েছিল মূলত শোভাবাজার রাজবাড়ি থেকে।
গ্যাসবাতির একচেটিয়া রাজত্বে হানা দেয় বৈদ্যুতিক বাতি। প্রথম বিদ্যুতের আলো (Electricity) এল ১৮৭৯ সালের ২৪ জুলাই। পি ডব্লু ফ্লিউরি অ্যান্ড কোম্পানি এ শহরে প্রথম বিদ্যুতের আলো জ্বালে। বছর দুয়েক পরে ১৮৮১ সালের ৩০ জুন গার্ডেনরিচের কটন মিলে ৩৬টি বাল্ব জ্বালায় 'দে শীল অ্যান্ড কোম্পানি'। এ সবই চলছিল পরীক্ষামূলকভাবে। বড় পরিবর্তনটা এল আর কয়েক বছর পরে। ততদিনে টমাস আলভা এডিসনের সৌজন্যে ইংল্যান্ড ও আমেরিকার ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো জ্বলতে শুরু করেছে। তখন ১৮৮৯ সাল। বৈদ্যুতিক বাতির রমরমা শুরু হয় তারপর থেকে। ১৮৯৯ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে কলকাতা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। কলকাতায় প্রথম যে রাস্তা বৈদ্যুতিক আলোর সংস্পর্শে এসেছিল, তা হল হ্যারিসন রোড বর্তমানে যা মহাত্মা গান্ধী রোড। প্রায় তিন বছর ধরে এই রাস্তায় আলো বসানোর কাজ চলেছিল। ১৮৯৫ সালে ক্যালকাটা ইলেকট্রিক লাইটিং অ্যাক্ট পাশ করেছিল তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার। তারপর বৈদ্যুতিক আলোকে আজ পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৮৯৭ সালের ৭ জানুয়ারি একুশ বছরের জন্য শহরকে আলোকিত করার লাইসেন্স পেয়েছিল ইন্ডিয়ান ইলেকট্রিক কোম্পানি লিমিটেডের এজেন্ট কিল্বার্ণ অ্যান্ড কোম্পানি। কোম্পানির কাজকর্ম অবশ্য চলত লন্ডন থেকেই। মধ্য কলকাতার প্রিন্সেপ স্ট্রিটের কাছে ইমামবাগ লেনে প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করা হয়।
তখন কলকাতায় বিদ্যুতের (Electricity) দাম ছিল লন্ডনের মতোই। প্রতি ইউনিট এক টাকা। বিদ্যুত এসে কলকাতাকে অনেকটা বদলে দেয়। হাত পাখার জায়গা নেয় ইলেকট্রিক ফ্যান। ঘোড়ায় ট্রানা ট্রামের বদলে শুরু হয় বিদ্যুৎচালিত ট্রাম। কিন্তু, তখনও অনেকে বিদ্যুতের বদলে গ্যাসবাতির পক্ষে রায় দেন। ১৯১৩ সালে কলকাতা শহরে বসে ঘরোয়া ভোটাভুটির আসর। গুরুসদয় রোডের নাম তখন ছিল বালিগঞ্জ স্টোর রোড। সেখানে, গ্যাসবাতি নাকি বিজলিবাতি, এ নিয়ে হয় ভোটাভুটি। তাতে বিজলিবাতি হেরে যায়। উজ্জ্বলতা এবং খরচের দিক থেকে গ্যাসবাতি অনেকের পছন্দ। কিন্তু, তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। কারণ, ততদিনে সকলে এটাও বুঝে যান, কলকাতা শহরে নতুন যুগ শুরু হয়ে গিয়েছে। বিদ্যুতের যুগ। রবীন্দ্রনাথের কথায় "কেরোসিনের আলো পরে যখন এল তার তেজ দেখে আমরা অবাক।" ১৯৩৩ সালে সিইএসসি-র সদর দফতর কলকাতায় চলে আসে। ধর্মতলার ভিক্টোরিয়া হাউস। পরবর্তীকালে, কলকাতা শহরতলিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। গ্রামে গ্রামে পৌঁচ্ছে যায় বিদ্যুৎ। কলকাতা শহরে গ্যাস বাতি আসার পর খুব বেশিদিন রাজত্ব করতে পারেনি। তবে, কলকাতা শহরে বিদ্যুৎ আসার পর শতাধিক বছর ধরে এই শহরের রাজপথ আলোকিত করার দায়িত্ব নিয়েছে।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।