British Company: শরৎকালের দুর্গাপুজো আসলে পলাশীর যুদ্ধের স্মারক! কেমন ছিল কোম্পানির আমলে বাঙালির জাতীয় উৎসব?
কলকাতার পুরানো দুর্গাপুজো (সংগৃহীত ছবি)
হরিহর ঘোষাল
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: নবাবি আমলে দুর্গাপুজো (Kolkata Durga Puja) হত। তবে সেই সংখ্যাটি ছিল হাতে গোনা। ইংরেজ কোম্পানির আমলে দুর্গাপুজো জাঁকজমক রূপ পায়। আচমকা ইংরেজরা কেন দুর্গাপুজো জাঁকজমক করতে উদ্যোগী হলেন, তা নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে চর্চা রয়েছে। তবে এটা ঠিক, রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে যুদ্ধে সিরাজউদৌল্লা হেরে যাওয়ার পর ব্রিটিশ কোম্পানির (British Company) হাতে চলে যায় শাসন ক্ষমতা। দুর্গাপুজো করতে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হত সেই সময়।
পলাশীর যুদ্ধের স্মারক উৎসব আজ বাঙালির জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে বললে কিন্তু ভুল বলা হবে না! তবে তার আগে জানতে হবে, শোভাবাজর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেবের কথা। পলাশীর যুদ্ধের আগে তিনি ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুন্সি, পরে হয়েছিলেন সুতানুটির তালুকদার। পরবর্তীকালে তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসের মুন্সি হয়েছিলেন। এমনকী ড্রেক সাহেব তেজাউদ্দীনকে কোম্পানির মুন্সির পদ থেকে সরিয়ে সেখানে বসানো হয়েছিল নবকৃষ্ণকে। পলাশীর যুদ্ধের ফলে কপাল খুলে গেল নবকৃষ্ণের। আর্থিকভাবে তিনি সমৃদ্ধশালী হলেন। ক্লাইভের তিনি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পলাশীর যুদ্ধে কৌশলে জিতে বাংলার মুসলিমদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন ইংরেজরা। হিন্দুদের একটি অংশ এই হারটাকে নিজেদের পরাজয় মনে করে ইংরেজদের ঘৃণা করতেন। স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে এক পক্ষের মন জয় করার প্রয়োজন। আর সেই তাগিদেই হিন্দুদের দুর্গাপুজো রাতারাতি কোম্পানির পুজোয় পরিবর্তিত হয়ে যায়। গবেষকদের মতে, ইংরেজদের 'তুষ্টিকরণ নীতি'-ই ছিল এর নেপথ্যের কারণ। ইংরেজরা তখনও এদেশে জাঁকিয়ে বসেনি, তারা তখন অনকাংশেই ব্যবসায়ী এবং এদেশের আধা-শাসক। যার ফলে তারা চাইছিল, এদেশের মানুষদের খুশি করতে। যে কারণে এদেশের যাবতীয় ধর্মাচারের পুরো-পৃষ্ঠপোষকতা করতে নিজেরাই এগিয়ে আসে তারা। তখনই দুর্গাপুজোগুলিতে পৃষ্ঠপোষকতা শুরু হয় তাদের তরফে। তাই, দুর্গাপুজোয় (Kolkata Durga Puja) সামিল হলেন ইংরেজরা। এদেশের যাবতীয় ধর্মাচারের পুরো-পৃষ্ঠপোষকতা করতে নিজেরাই এগিয়ে আসে তারা। তখনই দুর্গাপুজোগুলিতে ইংরেজদের পক্ষ থেকে পৃষ্ঠপোষকতা শুরু হয়।
এ দেশে তো বরাবর বসন্তকালে দুর্গাপুজোর (Kolkata Durga Puja) প্রচলন ছিল। শরৎকালে আয়োজিত হত নবপত্রিকা পুজো। তা হলে এটা কী হল? ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের বিজয়োৎসব পালন করার জন্য বসন্তকালের দুর্গাপুজোকে শরৎকালে টেনে নিয়ে এসে নবপত্রিকাপুজোর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল। কাজটা করলেন নবকৃষ্ণ দেব আর রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ! মদত দিলেন ধূর্ত ক্লাইভ! আর আমজনতার দল সেই আমোদের জোয়ারে বয়ে গিয়ে নিজেদের এত বছরের সযত্নে লালিত সংস্কৃতির বিসর্জন দিয়ে ফূর্তির ফোয়াড়ায় গা ভাসালেন! অন্যান্য হিন্দু জমিদার বা ব্যবসায়ীরাও মহা উৎসাহে সেই ফুর্তিতে যোগদান করলেন!
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে বাংলার অন্যান্য জমিদাররা মানেন। তাই নবকৃষ্ণ দেব ক্লাইভকে দিয়ে শরৎকালে দুর্গাপুজো (Kolkata Durga Puja) সারা বাংলা জুড়ে প্রচলন করার দায়িত্ব দিলেন। ১৭৫৭ সালে ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধ হয়েছে। তার তিন-চার মাসের মধ্যেই যুদ্ধ জয়কে দুর্গাপুজোর মাধ্যমে বিজয় উৎসব করতে চাইলেন ক্লাইভ। আর সেটা হলও। অদ্ভুত ব্যাপার হল, ক্লাইভ নিজে খ্রিষ্টান আর মূর্তিপুজোর বিরোধী হয়েও স্রেফ রাজনীতির স্বার্থে 'হিন্দু প্রেমিক' সেজে নবকৃষ্ণের নবনির্মিত ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজোয় একশো একটাকা দক্ষিণা আর ঝুড়ি ঝুড়ি ফলমূল পাঠিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, দুর্গাপুজোর সময় তিনি নবকৃষ্ণের বাড়িতে উপস্থিতও ছিলেন। সেই পুজোয় কৃষ্ণচন্দ্র ও নবকৃষ্ণ-দুজনেই লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন। নবকৃষ্ণ টাকা পেয়েছিলেন সিরাজউদ্দৌলার গুপ্ত কোষাগার লুট করে আর কষ্ণচন্দ্র ক্লাইভের প্রত্যক্ষ কৃপায়। ক্লাইভের সুপারিশে কৃষ্ণচন্দ্রের বার্ষিক খাজনা বরাবরের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা করে কমে গিয়েছিল। ফ্যানি পার্কস লিখেছিলেন, "ধনিক বাঙালীবাবুরা পূজার সময় যে পরিমাণ অর্থব্যয় করেন তার হিসেব নেই।”
কোম্পানির দুর্গোৎসব (Kolkata Durga Puja) ঘিরে ছিল বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। যেমন, কার বাড়ির দুর্গাকে বেশি গয়না পরানো হয়েছে, কার বাড়িতে বাইরের প্রদেশের সুন্দরী বাইজি নাচবে, কার পুজোয় ইংরেজ রাজ-কর্মচারী হাজির থাকবেন, কিংবা কার বাড়ির পুজোয় অঢেল খানাপিনার আয়োজন করা হয়েছে, এমন হাজারটা বিষয়। এই বিষয়গুলি নিয়ে তখন সংবাদপত্রগুলিতে নিয়মিত খবর প্রকাশিত হত। আর সাধারণ মানুষ মুখিয়ে থাকতেন এই প্রতিযোগিতার খবর পড়তে। ১৮২৯ সালে 'সমাচার দর্পণ' লিখছে, 'প্রাক-কোম্পানি যুগের পুজো ছিল সর্বত্র প্রতিমা না হউক ঘটপটাদি এবং শ্রীশ্রীশালগ্রাম শিলাদির পুজো। আর পুজো। আর সে সময়ের আদর্শ মহারাজা হলেন কৃষ্ণচন্দ্র। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রথমত এই উৎসবে বড় জাঁকজমক করেন।'
১৮১৯ সালে 'ক্যালকাটা জার্নাল' লিখছে, 'এই প্রেসিডেন্সিতে ইতিপূর্বে এ ধরনের পুজো কেউ কখনও দেখেনি। সুগায়িকাদের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিপুল অর্থব্যয়ে আনা হচ্ছে।' কলকাতার এই পুজোগুলিতে বাইজি নাচ ছিল মুখ্য আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। শুধু দেশের বিভিন্ন প্রান্ত নয়, বিদেশ থেকে শিল্পীরা আসতেন। এ ব্যাপারে ১৮২৬ সালের গভর্নমেন্ট গেজেট লিখছে, 'গোপীমোহন দেবের বাড়িতে নাচবার জন্যে সুদূর ব্রহ্মদেশ থেকে একদল সুন্দরী এবং সুগায়িকা নর্তকী আনা হয়েছে।' দুর্গাপুজোর বাইজি নাচ ঘিরে ছিল এক বিরাট প্রতিযোগিতার আসর।
১৮৩৩ সাল নাগাদ ডিরোজিওর 'ইয়ং বেঙ্গল' জোরদার আওয়াজ তুলল কোম্পানির সহায়তায় বাবুদের দুর্গোৎসবের বেহিসেবি খরচপত্তর নিয়ে। তারা বলল, দুর্গাপুজোয় (Kolkata Durga Puja) বাইজি নাচিয়ে আম খানাপিনা করে কোম্পানি সরকার এবং বাবুরা সাধারণ মানুষের কী এমন হিত সাধন করছে? শুধু তাই নয়। কলকাতার বড়মানুষদের কী কী বিষয়ে খরচ করা উচিত সে বিষয়ে তারা একটি ফর্দ অবধি পেশ করল। যার মধ্যে ছিল 'বিলাতে গমনোপযুক্ত জাহাজ নির্মাণ', 'নানাবিধ শিল্প যন্ত্র স্থাপন” থেকে 'চাষ বৃদ্ধি'র দিকে নজর দেওয়ার মতো যুগান্তকারী দাবি। এবার কোম্পানির টনক নড়ল। আর সে বছরই বের হল কোম্পানির বিখ্যাত ঘোষণা, হিন্দুদের মন্দিরাদি থেকে সরকারিভাবে হাত উঠিয়ে নিচ্ছেন তারা। এর ক'বছরের মধ্যেই ১৮৩৭ সালে বন্ধ হয়ে গেল হিন্দুর উৎসবে তোপ দাগানো আর দুর্গাপুজোর ধুমধাম। অবশেষে ১৮৪০ সালে এল বিখ্যাত 'দশ নম্বরি আইন'। যে আইনের সহজ মর্ম ছিল, 'নেটিভরা প্রজা, আমরা রাজা। তাদের ধর্ম তাদের, আমাদের ধর্ম আমাদের।'
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।