Hooghly: বাংলায় মনোহরা মিষ্টির আদি কথা...
মনোহরা মিষ্টি (সংগৃহীত ছবি)
হরিহর ঘোষাল
রাজ্যজুড়ে মিষ্টির বাহার প্রচুর। জায়গা ভেদে সেখানকার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিখ্যাত, নামকরা কিছু মিষ্টি। রসগোল্লা, পান্তুয়া ছাড়াও রসের মিষ্টি হোক কিংবা ছানার সন্দেশ-মিষ্টির তালিকা বললে শেষ করা যাবে না। তবে, নাম যাই হোক না কেন, মিষ্টি খাওয়াতে খাদ্যরসিক বাঙালির জুড়ি ভার। এই প্রতিবেদনে আমরা জানাব, ব্রিটিশ আমলে তৈরি হওয়া মনোহরা (Monohora Sweet) মিষ্টির আদি কথা। বাংলাদেশের ঢাকার প্রাণহরার সঙ্গে মনোহরার ব্যুৎপত্তিগত সাদৃশ্যকে তুলে ধরার জন্য কবি মোহিতলাল মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বলতেন, "তোরা মিষ্টির নাম রাখিস প্রাণহরা, আর আমরা নাম রাখি মনোহরা।"
মনোহরা হুগলি না মুর্শিদাবাদের, তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। হুগলিবাসীর দাবি, এই মিষ্টি জনাইয়ে প্রথম তৈরি হয়েছিল। মুর্শিদাবাদে নবাবের দেশের মানুষরা আবার মনোহরা মিষ্টির (Monohora Sweet) তৈরির কৃতিত্ব বেলডাঙা, কান্দির ময়রাদের দিতে চান। বিতর্কে না গিয়ে, দুটি জেলারই মিষ্টি তৈরির ইতিহাস আমরা তুলে ধরছি। একটি মত থেকে জানা যায়, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে রজগোপাল সাহা বেলডাঙায় প্রথম মনোহরা মিষ্টি তৈরি করেছিলেন। বাংলা টপ্পার জনক রামনিধি গুপ্ত ওরফে নিধুবাবু শহরের বাবুগিরির গানে লিখেছেন "খাওয়াইব গণ্ডা গণ্ডা মনোহরা দেদো মণ্ডা। খেয়ে খেয়ে যাবে প্রাণটা, বলবে বলিহারি যাই।” মুর্শিদাবাদের কান্দি, বেলডাঙার মনোহরার সুখ্যাতি সেকালে কালাপানি পাড় হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সাহেবদের দেশেও।
অন্য একটি মতে, মুর্শিদাবাদের নবাবদের খাস ময়রা এই মিষ্টি অষ্টাদশ শতকে আবিষ্কার করেন। জনৈক ময়রা বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার দহগ্রামের নিকট কিরীটকোনা গ্রামের কিরীটেশ্বরী মন্দিরের নিকট বাস করতেন। সেখানেই তিনি প্রথম মনোহরা মিষ্টি প্রস্তুত করেন। মুর্শিদাবাদের নবাবরা ডাবের শাঁস, কাজুবাদাম, এলাচ ও ক্ষীর দিয়ে তৈরি মনোহরা পছন্দ করতেন। নবাবির পতনের সঙ্গে সঙ্গে মনোহরা রাজকীয় পৃষ্ঠাপোষকতা থেকে বঞ্চিত হয়। যে মিষ্টি এককালে সমগ্র মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রস্তুত হত, তা ক্রমে বেলডাঙা, কান্দির মতো বিশেষ কিছু জায়গায় প্রস্তুত হতে থাকে। বাংলার মিষ্টির ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, মনোহরার জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে তাঁদের মধ্যে অনেক মতভেদ রয়েছে। সে যাই হোক, দুধসাদা মনোহরার মাথায় বাহারি কিসমিসের অলঙ্করণে সত্যিই মনোহরা মুর্শিদাবাদের এই মিষ্টি। বেলডাঙার মনোহরা যদি অসিত সাহা, মদনগোপাল সাহারা বাঁচিয়ে রাখেন, তবে কান্দির সুনাম রক্ষা করে চলেছেন শিবশক্তি দে বা রুদ্রদেব দত্তেরা। সেই ট্রাডিশন এখনও চলছে।
চাঁচি, ক্ষীর আর ছানার সঙ্গে এলাচ, জায়ফল আর জয়িত্রীর মিশ্রণে তৈরি 'পুর' চিনির মোটা রসের আস্তরণে ঢেকে রাখার অননুকরণীয় শিল্পের নাম মনোহরা। ছানা এবং চিনি হল এই মিষ্টির আসল উপকরণ। ছানা ভালো করে মেখে নেওয়ার পরেই তাকে চিনির সঙ্গে পাক দেওয়া হয়। মেশানো হয় এলাচ, ডাবের শাসের পাতলা আস্তরণ। তারপর সেই পাক হাতে গোল করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এটিকে রূপদান করা হয়। সবশেষে শিরায় সেটিকে মেশানো হয়। একবার কোট করেই তুলে নেওয়া হয়। ব্যস, মনোহরা তৈরি!
হুগলির (Hooghly) জনাইয়ে প্রথম মনোহরা (Monohora Sweet) তৈরি হয়েছিল। এই মিষ্টি তৈরির ইতিহাস দু'শো বছরের ওপর। জনাইয়ের মনোহরার উৎপত্তি নিয়ে একাধিক মত প্রচলিত আছে। একটি মতে, ভীমচন্দ্র নাগের পিতা পরাণচন্দ্র নাগ ছিলেন বর্ধমান রাজের দেওয়ান। এক সময়ে তিনি দেওয়ানের চাকরি ছেড়ে মিষ্টির ব্যবসায় নামেন। হুগলি জেলার জনাইতে তিনি মিষ্টির ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময়েই তিনি মনোহরা নামক মিষ্টির প্রচলন করেন। আর একটি মত থেকে জানা যায়, জনাইয়ের ময়রারা সন্দেশকে সংরক্ষণ করার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় ভুলবশতঃ সন্দেশকে চিনির রসে ডুবিয়ে ফেলেন। তার থেকেই সৃষ্টি হয় মনোহরা। এছাড়া জনাইয়ের জনৈক ললিত ময়রা ১৮৬০-এর দশকে মনোহরা মিষ্টি তৈরি করেন বলে দাবি করা হয়। আর একটি মত থেকে জানা যায়, জনাইয়ের জমিদার তখন কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান ছিলেন। সমৃদ্ধি ছিল শহরে। এমনই এক সময় ইংরেজ এক সাহেবের আগমনে রাজবাড়ি (কালীবাবুর বাড়ি) জুড়ে হইহই রইরই রব। মিষ্টি তো সবাই বানায়। তবে রসের বাঁধন থাকবে, ধাঁচ হবে শুকনো এমন মিষ্টি কোথায় পাওয়া যায়? সালটা ১৮৬৮ হবে, কালীবাবুর অনুরোধেই ন্যাড়া ময়রা বানালেন দুর্দান্ত স্বাদের এক মিষ্টি, নাম তখনও অজানা। ইংরেজ সাহেবের পাতে পড়তেই স্বাদ আস্বাদনে আর দেরি করলেন না। মিষ্টি মুখে দেওয়ার পরই একেবারে মিলিয়ে গেল। আবেগে আপ্লুত সাহেব কাটা কাটা বাংলায় বললেন, "এই মিষ্টি আমার মন হরণ করে নিয়েছে।" ব্যস! সেই থেকে মন হরণ করা এই মিষ্টির নাম হল মনোহরা।
জনাইয়ের মনোহরা (Monohora Sweet) এক সময় কলকাতার রসগোল্লা, শক্তিগড়ের ল্যাংচা ও বর্ধমানের সীতাভোগের মতো সমান জনপ্রিয় ছিল। মুখে মুখে এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায় এবং ক্রমে সারা ভারতে। ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় এবং ব্রিটিশ অভিজাতরা অতিথি আপ্যায়নের জন্য জনাইয়ের মনোহরা আনাতেন। ক্রমে ব্রিটেনেও মনোহরার বাজার তৈরি হয়। পরবর্তীকালে মনোহরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানিতেও রফতানি হতে থাকে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মনোহরার (Monohora Sweet) খুব ভক্ত ছিলেন। ছবি বিশ্বাস, উত্তম কুমার ও ছায়া দেবীর মতো বাংলা চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকারা আউটডোর শুট করে কলকাতা ফেরার পথে প্রায়ই গাড়ি থামিয়ে মনোহরা কিনে বাড়ি ফিরতেন। আজও হাজারো মিষ্টির ভিড়ে মনোহরা নিজের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। মুর্শিদাবাদ-হুগলিবাসী বলে নয়, মনোহরার স্বাদ একবার যিনি চেখে দেখেছেন, তাঁর মন জয় করে নিয়েছে ব্রিটিশ আমলে জন্ম নেওয়া এই মিষ্টি।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।