West Bengal: আজ ‘ভারত কেশরী’র জন্মদিন, জানুন পশ্চিমবঙ্গ গঠনে তাঁর অবদান
মুসলিম লিগের হাত থেকে পশ্চিমবঙ্গকে উদ্ধার করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (ফাইল ছবি)
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: ১৯০১ সালের ৬ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (Shyama Prasad Mukherjee)। তাঁকে ‘ভারত কেশরী’ বলেও সম্বোধন করা হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, তিনিই ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের জনক। মুসলিম লিগের পাতা ফাঁদ থেকে তিনি উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছিলেন বাঙালি হিন্দুদের। মূলত তাঁর প্রচেষ্টাতেই অখণ্ড বাংলার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমাংশ থেকে যায় ভারতে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অখণ্ড বাংলাকে নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে সুরাবর্দীর প্রস্তাবও ব্যর্থ করেন তিনি। আজ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিনে আমরা জানব কীভাবে তিনি পশ্চিমবঙ্গকে (West Bengal) ভারতে রাখতে সমর্থ হলেন!
১৯৪৬ সালের ১৬ অগাস্ট দিনটি ছিল শুক্রবার। বাঙালি হিন্দুর জীবনে সেদিন নেমে আসে এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে’র নামে, পাকিস্তানের দাবিতে মুসলিম লিগ শুরু করল হিন্দু নিধনযজ্ঞ। অবিভক্ত বাংলায় তখন ছিল সুরাবর্দীর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লিগের সরকার। মুসলিম লিগের গুন্ডারা হিন্দুদের ওপর ভয়াবহ সম্প্রদায়িক হামলা শুরু করে। পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। কয়েক হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হয়। হাজার হাজার হিন্দু নারী ধর্ষিতা হন। লুট করা হয় সম্পত্তি। ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’-এর পরেই নোয়াখালিতে মুসলিম লিগ শুরু করে ফের এক হিন্দু নিধনযজ্ঞ। উদ্দেশ্য একটাই, পাকিস্তান। বর্তমান বাংলাদেশের নোয়াখালি, লক্ষ্মীপুর, ফেনী জেলা নিয়ে মেঘনার বাম তীরে অবস্থিত ছিল ব্রিটিশ আমলের নোয়াখালি জেলা। এই জেলাতে তৎকালীন সময়ে হিন্দুদের জনসংখ্যা ছিল ১৮ শতাংশ। ১৯৪৬ সালের ১০ অক্টোবর ছিল কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো। স্থানীয় হিন্দু বাড়িগুলিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে লিগের গুন্ডারা। গণহত্যা, লুট, গৃহে অগ্নিসংযোগ, অপহরণ ,নারী ধর্ষণ-এই সমস্ত কিছুই চলতে থাকে মুসলিম লিগের নেতা মওলানা গোলাম সারোয়ারের নেতৃত্বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এক নোয়াখালিতেই হত্যা করা হয়েছিল ১০ হাজার হিন্দু বাঙালিকে। এর থেকেও বেশি সংখ্যক মানুষকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়। অগণিত মহিলাকে ধর্ষিতা হতে হয়।
অবিভক্ত বাংলায় তখন মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। মুসলিম লিগ নেতৃত্বের দাবি, কলকাতা সহ সমগ্র বাংলাকেই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সেই দাবিতেই ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ ও ‘নোয়াখালি গণহত্যা’। এদিকে সমগ্র বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তিকরণের বিরুদ্ধে হিন্দু বাঙালিদের মধ্যেও গড়ে উঠেছে প্রবল জনমত। মুসলিম লিগের নেতা তথা ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’- এর খলনায়ক সুরাবর্দী তখন এক ফাঁদ পাতলেন। দুই বাংলাকে নিয়ে অখণ্ড স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি করার প্রস্তাব রাখলেন তিনি। অর্থাৎ অখণ্ড বাংলা, না হবে ভারতের, না পাকিস্তানের। কিন্তু এরপরেও বাংলাতে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে যেত। আশ্চর্যজনকভাবে অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্রের দাবিতে সম্মতি দিলেন মহম্মদ আলি জিন্না। অর্থাৎ যেনতেন প্রকারেন তৎকালীন অখণ্ড বঙ্গের পশ্চিমাংশ যা বর্তমানের পশ্চিমবাংলা, যেখানে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেটিকে ভারত থেকে আলাদা করতেই হবে। সুরাবর্দীর এমন পাতা ফাঁদে পা দেন কংগ্রেসের দুই নেতা শরৎচন্দ্র বসু ও কিরণশঙ্কর রায়। এমন সময়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বুঝতে পারলেন যে হিন্দু বাঙালির অস্তিত্ব বিপন্ন করতে ফাঁদ পেতেছে মুসলিম লিগ। হয়তো পাকিস্তানে নিয়ে যেতে চাইছে অথবা স্বাধীন রাষ্ট্রের নামে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে হিন্দুদের তারা সংখ্যালঘু করে রাখতে চাইছে।
সেই সময় থেকেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁর সমস্ত শক্তিকে নিয়োজিত করলেন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গকে ভারতে রাখার জন্য। ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই হিন্দু মহাসভার নেতৃত্বে তিনি একটি কমিটি গঠন করেন এবং সারা বাংলা জুড়ে সফর শুরু করেন। বড় বড় জনসভাগুলিতে বক্তব্য রাখেন। মানুষকে বাংলা ভাগের প্রয়োজনীয়তা তিনি বোঝাতে থাকেন। কংগ্রেসের নেতাদের কাছেও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (Shyama Prasad Mukherjee) আবেদন রাখেন যে তাঁরা যেন বাংলা ভাগের দাবিকে সমর্থন জানান। ১৯৪৭ সালের ১৫ মার্চ কলকাতায় হিন্দু মহাসভা একটি দু-দিনব্যাপী আলোচনাসভার আয়োজন করে। এতে হাজির ছিলেন ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার, ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ। এই সভায় সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে হিন্দু মহাসভা। অখণ্ড বাংলার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলিকে নিয়ে একটি আলাদা প্রদেশ গঠন করার কথা লেখা হয় প্রস্তাবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ওই প্রস্তাব পেশও করে হিন্দু মহাসভা। ঠিক এমন আবহে তৎকালীন জনপ্রিয় দৈনিক ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ ১৯৪৭ সালের ২৩ মার্চ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত একটি সমীক্ষা করে। বিষয় ছিল, বাংলা ভাগ করা উচিত কিনা। এই সমীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হয় ১৯৪৭ সালের ২৩ এপ্রিল। জানা যায়, এতে মোট ৫ লাখ ৩৪ হাজার ২৪৯ জন মানুষ নিজেদের মতামত রাখেন। ৯৮. ৩ শতাংশ মানুষই বাংলা ভাগের পক্ষে কথা বলেন। অন্যদিকে, বাংলা ভাগের বিপক্ষে কথা বলেন ০.৬ শতাংশ মানুষ। ১.১ শতাংশ মানুষের মতামত বাতিল হয়।
এমন সময় ১৯৪৭ সালের ২৩ এপ্রিল শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের (Shyama Prasad Mukherjee) সঙ্গে বড়লাট মাউন্টব্যাটেনের একটি বৈঠক হয়। সেখানে ভারত কেশরী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে বোঝান, ‘কেন বাংলা ভাগ করা প্রয়োজন’। আবার ১৯৪৭ সালের ২ মে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মাউন্টব্যাটেনকে বাংলা ভাগের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে একটি দীর্ঘ পত্র লেখেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের এমন আন্দোলন সে সময় খবরের শিরোনামেও আসে। তৎকালীন কলকাতার দৈনিক 'দ্য স্টেটসম্যান' ১৯৪৭ সালের ২৪ এপ্রিল একটি খবর প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে তারা জানায়, বাংলা ভাগ করার আন্দোলন একটি বিশাল ঝড়ে পরিণত হয়েছে। এই ঝড় আরম্ভ করেছিল হিন্দু মহাসভা। ঝড়ের কেন্দ্রভূমি হচ্ছে কলকাতা। ১৯৪৭ সালের মে মাসের প্রথম দিকে ভারত কেশরী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বাংলা ভাগের প্রয়োজনীয়তার কথা মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহরুকেও বলেন। তবে তাঁরা এ বিষয়টি খুব একটা আমল দেননি বলেই জানা যায়। ১৯৪৭ সালের ১৩ মে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সোদপুরে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। সেখানেও তাঁকে একই কথা বলেন।
তৎকালীন কংগ্রেস নেতা সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে চিঠি লেখেন এবং সেখানে তিনি বলেন, ‘‘শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। বাংলার হিন্দুরা যতদিন নিজেদের স্বার্থ বুঝছে এবং নিজেদের অবস্থান থেকে না সরছে, ততদিন ভয়ের কোনও কারণও নেই। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার ডাক মুসলিম লিগের পাতা ফাঁদ ছাড়া কিছু নয়। বাংলাকে কখনই ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না।’’ এই সময়ে বাংলা ভাগের দাবিতে বারোটিরও বেশি জনসভা করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। পাঁচটি করেন কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথভাবে। কংগ্রেস বাংলা ভাগের দাবিকে শেষ মুহূর্তে সমর্থন জানায়। তার কারণ ছিল একটাই যে তাদের হিন্দু ভোটাররা যেন না সরে যায়।
দীর্ঘ আন্দোলন এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াসের পরে ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বঙ্গীয় আইন পরিষদের পশ্চিমাংশের সদস্যরা বাংলার দ্বিখণ্ডীকরণের প্রস্তাব বা পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) প্রস্তাব ৫৮-২১ ভোটে পাশ করান। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মুসলিম লিগের পাতা ফাঁদ থেকে বের করে আনেন হিন্দু বাঙালিকে। হিন্দু বাঙালি পায় তার নিজস্ব হোমল্যান্ড। ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ ও নোয়াখালির দাঙ্গার পরেও মুসলিম লিগ সমগ্র বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হয়। ব্যর্থ হয় স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের নামে হিন্দু বাঙালিকে দাস করে রাখার পরিকল্পনা। মুসলিম লিগের যাবতীয় চক্রান্তকে প্রতিহত করতে সমর্থ হন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।