১৯৪৭ সালের মে মাসে, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, মাউন্টব্যাটনকে একটি চিঠিতে লেখেন, 'ভারত না হলেও বাংলাকে অবশ্যই ভাগ করতে হবে'। ভাগ না হলে পশ্চিম অঞ্চলে হিন্দু অধ্যুষিত বাংলা ধ্বংস হয়ে যাবে'।
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ১২১ তম জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ
বেঁচে থাকলে বয়স হত ১২১ বছর। কিন্তু ১২১ লাইনও কেউ খরচ করলেন না শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্য। গত শতাব্দীর প্রথম বছরে জন্ম শ্যামাপ্রসাদের। অথচ তাঁর পিতা আশুতোষ মুখোপাধ্যাকে নিয়ে বাঙালির প্রজ্ঞার উৎসাহ দেখার মত। কিন্তু তাঁরই সন্তান, তার মতই শিক্ষাবিদ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে কমবয়সী উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদকে রেখে দেওয়া হয়েছিল সেই অন্ধকারেই। এর পিছনে বাংলার রাজনীতি যেমন দায়ী, তেমনই দায় ইতিহাস বিস্মৃত বাঙালি জাতির। যারা কোন দিন সচেতন ভাবে চর্চা করলেন না গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে দাপিয়ে বেড়ানো এই বাঙালি মনীষার ওপর।
বহুদিন ভুলিয়ে রাখার পর যখন শ্যামাপ্রসাদ চর্চা শুরু হল, তখন থেকে নিত্য দিন নতুন ভাবে বাঙালি চিনতে শুরু করলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে। যিনি একাধারে শিক্ষক-উপাচার্য। একাধারে সচেতন রাজনীতিবিদ। যোগ্য বিধায়ক, সাংসদ। এবং একজন দার্শনিক। যার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ফসল আজ সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
শুধু শিক্ষাবিদ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে নিয়েই লিখে ফেলা যায় গোটা প্রবন্ধ। কিন্তু অল্প কথায় জেনে নেওয়া যাক, এই মেধাবী প্রজ্ঞার সম্পর্কে। ১৯৩৪ সাল, শ্যামাপ্রসাদের বয়স মাত্র তেত্রিশ বছর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। চার বছরের মেয়াদ। চৌত্রিশ থেকে আটত্রিশ সাল। এই চার বছরেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রায় ঢেলে সাজানোর কাজ করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। শিক্ষাবিদ শ্যামাপ্রসাদের হাত ধরেই, দীর্ঘদিনের প্রায় আশি বছরের ইংরাজির জগদ্দল সরিয়ে বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ আসে বাঙালি মেধায়। এছাড়া মহিলাদের জন্য বিশেষ পাঠক্রম ও হোম সায়েন্সের পঠনপাঠন চালু করা ও কৃষিবিদ্যা নিয়ে লেখাপড়ার শুরুও তাঁর হাতে। এমনকি রাজ্য যখন শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে উত্তাল, তখন আরও বেশি করে মনে করা উচিত শিক্ষাবিদ শ্যামাপ্রসাদকে। কারণ তাঁর হাত ধরেই শিক্ষক প্রশিক্ষণ পাঠক্রম চালু হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিদেশি ভাষা শিক্ষায় তিনি জোর দেন চিনা আর তিব্বতি ভাষায়। হিন্দি, উর্দু, অহমিয়া ভাষা শিক্ষাতেও জোর দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৩৭ সালের সমাবর্তনে প্রথমবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ভাষণ দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং।
১৯৩৯ সাল। ব্রিটিশ শাসকের সঙ্গে কংগ্রেসের একটা বড় অংশের আপোষের মনোভাব। কারণ দেশের বড়লোকেদের প্রতিনিধিত্ব করছিল কংগ্রেস। গান্ধীর অহসযোগ, অহিংস আন্দোলনের সঙ্গে সশস্ত্র আন্দোলনের বিরোধ তখন তুঙ্গে। দেশের স্বাধীনতার যোদ্ধারা পথ খুঁজছেন ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি লাভের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর বছর। যুগসন্ধিক্ষণের সময়। ভারতের রাজনীতিতে ঘটে গেল এক বিচিত্র ঘটনা। বাংলার দুই রাজনীতিবিদ কংগ্রেস ছাড়লেন। একজন সুভাষচন্দ্র বসু, আরেকজন অবশ্যই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। কংগ্রেসের ব্রিটিশ আপোষকামী রাজনীতির বিরোধিতা করে দুজনে হাঁটলেন দুই পথে। সুভাষচন্দ্র যখন তৈরি করছেন ফরওয়ার্ড ব্লক, ঠিক তখনই শ্যামাপ্রসাদ যোগ দিচ্ছেন 'হিন্দু মহাসভা'য়। ১৯৩৯ সাল। সাভারকরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হিন্দু মহাসভায় যোগদান শ্যামাপ্রসাদের। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ঠিক তাঁর পরের বছর, ১৯৪০, কার্যনির্বাহী সভাপতি করা হয় তাঁকে। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ সাল। হিন্দু মহাসভা সভাপতি হিসেবে কাজ করেছেন শ্যামাপ্রসাদ।
সময়টা লক্ষ্য করুন, ১৯৪২-এ ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয়েছে। যার বিরোধিতা করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। কংগ্রেসের ভিতরেও তখন দোটানা, দোলাচল। ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস নাকি পূর্ণ স্বাধীনতা? কংগ্রেসের ভিতরে বাইরে বিতর্ক চরমে পৌছাচ্ছে। এর আগেই ১৯০৫ সালে বাংলায় দ্বিজাতি তত্ত্বের বীজ বপন করে গেছে ব্রিটিশরা। তাঁর বিষময় ফল ফলতে শুরু করেছে দেশে। ১৯২৯ সালে বাংলা প্রভিন্সের বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের টিকিটে প্রথমবার নির্বাচিত হয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। মাঝে কেটে গেছে ১৪ বছর। ততদিনে বুঝে গেছেন শ্যামাপ্রসাদ, বাংলার পরিণতি কি হতে চলেছে। কারণ ১৯২৯-৩০ সালের অভিজ্ঞতা তাঁর কাছে উজ্জ্বল। স্পষ্ট কংগ্রেসের ভূমিকাও। কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা বাংলার আইনসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। দলের নীতি মেনে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন শ্যামাপ্রসাদও। কিন্তু নিজস্ব অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলেন, আইনসভার ভিতরে থেকেই লড়াই চালাতে হবে। প্রয়োজনে কৌশলগত অবস্থান নিতে হবে। সেই কারণে ১৯৩০ সালেই নির্দল হিসেবে জিতে আসেন নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষেত্র থেকে। কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কের হয়তো সেখানেই ইতি। এরপরে অবশ্য ফজলুর হকের মন্ত্রী সভার অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেছিলেন যোগ্যতার সঙ্গে।
ঠিক যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থার দিনগুলি। ক্লাসে তাঁর উপস্থিতিকেই ভয় পেতেন তাঁর মেধাবী সহপাঠীরা। জানতেন শ্যামাপ্রসাদ যে ক্লাসে থাকবেন সেখানে তিনিই টপার হবেন। মন্ত্রীসভাতেও তেমনি। আইনসভার ভিতরে শ্যামাপ্রসাদের ব্যক্তিত্ব যুক্তিবোধ আর বাগ্মীতা সহজেই নজর কাড়ল। বাড়ছিল জনপ্রিয়তাও। ফলে বিরোধিতাও এল। কারণ ফজলুর হকের পার্টি তখন মুসলিম লিগের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে গিয়ে চরম অবস্থানে পৌঁছাচ্ছে। বাংলার চেহারা তখন দুই প্রান্তে দুরকম। পশ্চিমপ্রান্তে হিন্দু আধিক্য থাকলেও মুসলিমদের হাতে অর্থনীতির চাবিকাঠি। ঠিক তাঁর উলটো ছবি পূর্ব প্রান্তে। লড়াইটা দাঁড়িয়ে গেছিল দেশ ভাগের প্রশ্নে। বাংলার অবস্থান কোনদিকে থাকবে। যে বাঙালি হিন্দুর মেধার কাছে নেতৃত্বের কাছে, রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কাছে কংগ্রেসের তৎকালীন নেতারা নিয়ম করে হেরে যাচ্ছেন। যতবার হারছেন, ততবার গান্ধীজিকে সামনে রেখে পলায়নের পথ খুঁজছিলেন সেই সময়ের নেহেরু ফলোয়াররা। তাঁরা চাইছিলেন পাকিস্তানের অংশ হোক বেশিরভাগ বাংলা। বাকি অংশ জুড়ে দেওয়া হোক বিহার ঝাড়খণ্ডের সঙ্গে। হিন্দু বাঙালি সত্ত্বার রাজনীতি নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন যে মানুষটা তিনিই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা ঠেকাতে মুখার্জি ১৯৪৬ সালেই বঙ্গভঙ্গের দাবি জানান। তারকেশ্বরে ১৫ এপ্রিল ১৯৪৭ তারিখে হিন্দু মহাসভার ডাকে একটি সভা তাঁকে বঙ্গভঙ্গ নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার অনুমোদন দেয়। ১৯৪৭ সালের মে মাসে, শ্যামাপ্রসাদ লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে একটি চিঠি লেখেন, যাতে বলা হয়, ভারত না হলেও বাংলাকে অবশ্যই ভাগ করতে হবে। সে সময়, ১৯৪৭-এ শরৎ বসু এবং বাঙালি মুসলিম রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দাবি ছিল একটি অখন্ড কিন্তু স্বাধীন বাংলার। শ্যামাপ্রসাদ এর বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল পরিষ্কার, ভাগ না হলে পশ্চিম অঞ্চলে হিন্দু অধ্যুষিত বাংলা ধ্বংস হয়ে যাবে।
ঠিক সেই সময়ে পূর্ব বাংলায় নোয়াখালী গণহত্যা। যেখানে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে হিন্দুগণহত্যা চালানো হয়েছিল। মুসলিম লীগের হিন্দু সাফাই অভিযানের পিছনে যে রাজনীতি লুকিয়ে ছিল তা হল, সেই সময়ে মুসলিম লীগের প্রস্তাব। যে প্রস্তাবে বলা হল, সমগ্র বাংলাপ্রদেশকে পাকিস্তানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। যা হবে, ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের জন্য একটি স্বদেশ। এইখানেই বোঝা যায়, শ্যামাপ্রসাদের দূরদর্শিতা। হিন্দু বাঙালির নিজস্ব বাসভূমির পক্ষে তাঁর সওয়াল দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত করেছিল অবিভক্ত বাংলার হিন্দু সমাজকে। এরপর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি নেতৃত্বে "বেঙ্গলি হোমল্যান্ড মুভমেন্ট" শুরু হয়। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ১৯৪৭-এর দেশভাগ, বলা ভাল বাংলা ভাগকে মেনে নেন বাঙালি হিন্দু জনগণ। যা আসলে স্বাধীন ভারতীয় ইউনিয়নের মধ্যে নিজেদের জন্য একটি বাসস্থান, আবাসভূমি। যাকে আমরা আজকের দিনে পশ্চিমবঙ্গ বলে চিনি।
২১ জুন পশ্চিমবাংলার জন্মদিন। আর তাঁকেই ভুলে গেছিল বাংলার মানুষ।
জন্মদিনের প্রণাম ভারত কেশরী শ্যামাপ্রসাদ।