মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: ব্রিটিশদের কথা ভাবলে ভারতীয়দের ওপর অত্যাচার, জোর-জুলুমের কথাই বেশি মাথায় আসে। কিন্তু তাদের শাসিত ভারতে ব্রিটিশরা এমন সব স্থাপত্য দিয়ে গিয়েছে, যেগুলির ভূমিকাও উপেক্ষা করার নয়। ব্রিটিশদের এই ধরনের কৃতিত্বের মধ্যে অন্যতম হল কলকাতায় অবস্থিত 'টালা ট্যাঙ্ক'। এই সুবিশাল ওভারহেড রিজার্ভারটি শুধু ভারত নয়, সমগ্র বিশ্বের বৃহত্তম ওভারহেড জলের ট্যাঙ্ক (Tala Tank)। এটি কোনও সাধারণ ট্যাঙ্ক নয়। এর পিছনে আছে অনেক ইতিহাস।
কী উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল এই ট্যাঙ্ক (Tala Tank)?
ব্রিটিশ আমলে ধীরে ধীরে কলকাতা যখন একটি পূর্ণ শহরে পরিণত হচ্ছে, সেই সময় পরিষেবা বাড়ানো ছিল ব্রিটিশদের মূল লক্ষ্য। তার মধ্যে সব থেকে বেশি যেটির প্রয়োজন ছিল, তা হল নাগরিকদের জন্য পানীয় জলের ব্যবস্থা করা। আর সেই উদ্দেশ্যেই কয়েকটি পুকুর খনন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হেদুয়া, ওয়েলিংটন স্কোয়ার, ভবানীপুরের পুকুর থেকে সেই সময় কলকাতায় পানীয় জল সরবরাহ শুরু হয়। কিন্তু, শহর আরও বাড়তে থাকলে পানীয় জলের প্রয়োজনও বাড়তে থাকে। এই সমস্যাকে মাথায় রেখে তৎকালীন পৌর ইঞ্জিনিয়ার মিস্টার ডেভেরাল তাঁর সহকারী মিস্টার পিয়ার্স-এর সাথে মিলিতভাবে ১৯০১ সালে একটি ওভারহেড ট্যাঙ্ক (Tala Tank) তৈরির প্রস্তাব তুলে ধরেন। এই প্রস্তাবটি ১৯০২ সালে গ্রহণ করা হয়।
কত খরচ হয় এই ওভারহেড জলের ট্যাঙ্ক (Tala Tank) নির্মাণে?
১৯০৩ সালে পুরসভায় নিযুক্ত হন নতুন ইঞ্জিনিয়ার ডব্লু বি ম্যাকক্যাবে। তিনি এই প্রস্তাব দেখেন এবং কিছু রদবদল করার সিদ্ধান্ত নেন, যাতে কলকাতার মানুষ আরও উন্নত জল পরিষেবা পেতে পারে। আর এই প্রস্তাবে সম্মতি জানায় সমস্ত পৌরসভা। এই সময় ট্যাঙ্কটি (Tala Tank) নির্মাণ করতে তিনি ৬৯ লক্ষ ১৭ হাজার ৮৭৪ টাকা খরচ ধার্য করেন, যা ছিল আগের অঙ্কের থেকে অনেকটাই বেশি। কিন্তু এতে পূর্ণ সমর্থন ছিল সবার।
কোথায় এবং কীভাবে নির্মিত হয় এই ট্যাঙ্কটি (Tala Tank)?
১৯০৯ সালে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার এডওয়ার্ড বেকার এই ট্যাঙ্ক নির্মাণের (Tala Tank) সূচনা করেন। ফাউন্ডেশনের কাজ শুরু করে টি সি মুখার্জি অ্যান্ড কোম্পানি। কংক্রিট ফাউন্ডেশনের কাজ শুরু করে স্যার রাজেন্দ্রলাল মুখার্জির মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি। আর তার সাথে বাকি কাজে যুক্ত ছিল লিডসের ক্লেটন কোম্পানি।
প্রথমে যে স্থানে ট্যাঙ্কটি নির্মাণ করা হবে, সেখানে পুকুরগুলি বোজানোর কাজ শুরু হয়। পুকুরগুলিকে জলশূন্য করে চারদিকে শালবল্লার খুঁটি দিয়ে ২০-২৫ ফুট পাইল করে খোয়া দিয়ে ভর্তি করে স্টিম রোলার দিয়ে সমান করা হয়। এর ওপর বোল্ড স্টিল জয়েন্টের ওপর স্তম্ভগুলিকে দাঁড় করানো হয়। ১৯১১-র ১২ জানুয়ারি এর কাজ শেষ হয় এবং এই বছরেই ১৬ই মে এটি চালু করা হয়। এটি ছিল ১১০ ফুট উঁচু, ১৬ ফুট গভীরতা বিশিষ্ট, ১ লক্ষ বর্গফুট আয়তনের। এর জলধারণ ক্ষমতা ৯ লক্ষ গ্যালন। গোটাটা চারটি কম্পার্টমেন্টে ভাগ করা হয়, যাতে জল পরিষেবা বন্ধ না রেখেই অন্য একটি ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করা যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৬২ ও ১৯৭১-এর যুদ্ধে লক্ষ্য ছিল টালা ট্যাঙ্ক (Tala Tank) ধ্বংস করা
ভারতীয় ইতিহাসের ঐতিহ্যবাহী অতীত বহন করে চলেছে এই টালা ট্যাঙ্ক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ট্যাঙ্ককে লক্ষ্য করে জাপানিরা পর পর অনেকগুলি বোমা নিক্ষেপ করে। কিন্তু ধ্বংস করতে পারেনি একে। মাত্র নয়টি বোমার ক্ষতচিহ্ন পাওয়া যায়। ১৯৬২ ও ১৯৭১-এর যুদ্ধেও চিন ও পাকিস্তানের লক্ষ্য ছিল এই ট্যাঙ্ক। কিন্তু তারাও কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এই টালা ট্যাঙ্ক। আজও তা (Tala Tank) কলকাতার জল পরিষেবার একমাত্র আধার হিসাবে জল পৌঁছে দিচ্ছে গোটা শহর জুড়ে।
আর বর্তমানে পরিচিতি পেয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ওভারহেড জলের ট্যাঙ্ক হিসেবে।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook, Twitter এবং Google News পেজ।
+ There are no comments
Add yours