সরস্বতী রাজামানি, নেতাজি যাকে দেশের প্রথম কনিষ্ঠতম গুপ্তচরের আখ্যা দিয়েছিলেন
জিরো-জিরো-সেভেন নয়। নয় হলিউডি নায়কের অবাস্তব কাণ্ডকারখানা। এ এক ভারতীয় গুপ্তচরের গল্প। বলা ভাল প্রথম ভারতীয় কন্যার গুপ্তচর হয়ে ওঠার গল্প। ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী এক গুপ্তচর কন্যার গল্প।
(গুলি ছোঁড়ার শট)
আজকের গল্প সরস্বতী রাজামনির। অসম্ভবকে সম্ভব করার এক বীরগাথা।
(আসল মুখঃ... জয় হিন্দ)
এই ছবি তখনকার। যখন তার বয়স নব্বই ছুঁই ছুঁই। তাঁকে নিয়ে তখন ডক্যুমেন্টারি বানাচ্ছে 'এপিক'। কিন্তু গুপ্তচরের কাহিনী প্রায় পঁচাত্তর বছর পিছিয়ে যেতে হবে। যেতে হবে রেঙ্গুন...
(রেঙ্গুন ম্যাপ...)
সদ্য ভারত বিচ্ছিন্ন বার্মায় তখন অনেক ভারতীয়ের বাস। অর্থবান ভারতীয়রা সেখানেই ব্যবসা বাণিজ্য করতেন। বেশিরভাগই ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। তেমনই রাজামানির পরিবার।
(অক্টোবর ৭, ১৯৩০)
ভগত সিং-এর ফাঁসির ঘোষণা করল লাহোর হাইকোর্ট। রেডিও বার্তায় ছড়িয়ে গেল দুঃসংবাদ! প্রায় চার বছরের এক কন্যা রেঙ্গুনে বসে শুনল সে কথা। সেদিন তাঁর পরিবারে পার্টি চলছিল। মুহুর্তে থেমে গেল সব কিছু।
(ডিসেম্বর ৮, ১৯৩০)
দু'মাস কাটতে না কাটতেই কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং থেকে ভেসে এলো বজ্র-নির্ঘোষ। তিনদিন বাদে রেঙ্গুন রেডিওতে ভেসে আসছে বিনয়-বাদল-দীনেশের বীরত্বের খবর। (বিনয় বাদল দীনেশ তিনজনের ছবি)
(২৩ মার্চ,১৯৩১)
ফাঁসি হল ভগত সিং-এর। ঐ বাচ্চা মেয়েটির বয়স তখন চারবছর দুমাস। গত ছমাসে তাঁর মনের হাজারও প্রশ্নের জবাব মিটিয়েছে তাঁর দেশপ্রেমিক বাবা-মা। সেই শুরু। মেয়েটি জানছে তাঁরা পরাধীন। রূপকথা নয়, মেয়েটি শুনছে, ১৮ এপ্রিল, ১৯৩০-এর যুদ্ধ। চট্টগ্রামের জালালাপাহাড়ে মরণপণ লড়াই বাংলার বিপ্লবীদের। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন মাস্টার দা সূর্য সেন আর তাঁর অনুগামীরা।
ছোট্ট রাজামানির মনে হাজারও প্রশ্ন। অনেকগুলো কেন?
গ্রাফিক্সঃ কেন? গ্রাফিক্স
(১২জানুয়ারি, ১৯৩৪)
ফাঁসি হল মাস্টারদা সূর্য সেনের। গোটা বাংলায় সেদিন অরন্ধন ছিল। ইথার তরঙ্গে রেঙ্গুনের ঘরে ঘরেও ঐ দিন হয়তো পৌছে গেছিল অরন্ধনের ডাক।
ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ঘৃণা। পরাধীনতার লজ্জা আর মাতৃভূমির স্বাধীনতার লক্ষ্য কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল মেয়েটাকে। রেঙ্গুন রেডিওতে ভেসে আসছে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নানা সংবাদ। একদিকে গান্ধিজীর অহিংস অসহযোগ,অন্যদিকে নেতাজির সশস্ত্র আন্দোলনের ডাক। একদিকে নন-কো-অপারেশন, অন্যদিকে ডাইরেক্ট অ্যাকশন। দুই ধারার বিতর্কে দেশ দুই ভাগ। আর গল্পের শুরু।
(সরস্বতী রাজামানি)
১৯৩৭
সেবার গান্ধীজী গেছেন বার্মায়। উদ্দেশ্য বার্মার ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহে। রাজামানির বাড়িতে এসেছিলেন গান্ধিজী। সকলে সেখানে হাজির থাকলেও গরহাজির বাড়ির কিশোরী কন্যা। সে তখন বাড়ির বাগানে শ্যুটিং প্র্যাক্টিস করছিল। বছর দশেকের রাজামানিকে বন্দুক চালাতে দেখে গান্ধিজীর প্রশ্ন হাতে বন্দুক কেন? রাজামানি জানিয়েছিলেন ব্রিটিশ মারার কথা। অহিংসার কথা বলে নিরস্ত্র করতে চান গান্ধিজী। মেয়েটি বলেন বাড়িতে ডাকাত পড়লে বন্দুক চালিয়েই ডাকাত তাড়াতে হয়। গান্ধিজী ফিরে যান। দ্বিগুণ উৎসাহে শ্যুটিং অভ্যাস শুরু করেন সে কন্যা।
(গুলি ছোঁড়ার শট)
অহিংসার কল্পনা নয় ডাইরেক্ট অ্যাকশনে বিশ্বাস দৃঢ় হচ্ছিল আর তাঁর আইডল হচ্ছিলেন নেতাজি
(সুভাষচন্দ্র বোস কোলাজ...কদম কদম বাড়ায়ে যা ...)
১৯৪১
মধ্য জানুয়ারির সকাল, ইথার তরঙ্গে বিদ্যুতের গতিতে ছড়িয়ে পড়ল ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছেন হাউস অ্যারেস্ট সুভাষ।
(কোলাজ)
শোনা গেল সেই বিখ্যাত বক্তৃতাঃ "তোমরা আমায় রক্ত দাও...আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।"
রাজামানিও ততদিনে বেছে নিয়েছেন তাঁর রাজনৈতিক গুরুকে।
(ডক্যুমেন্টারি নেতাজির ছবি লাগানো)
(কাট টু রেঙ্গুনের পুরানো শটস)
রেঙ্গুনে সুভাষের বক্তব্য শুনে একদিন পৌছে গেলেন আইএনএ-র দফতরে। সেদিন সেখানে ভারতীয়রা নেতাজির হাতে তুলে দিচ্ছিলেন নিজের দান। স্কুল থেকে ফেরার পথে নিজের যাবতীয় গয়না রাজামানি তুলে দিলেন আইএনএ প্রধানের হাতে।
( ...)
পরদিন অন্য বিপদ। নেতাজি স্বয়ং হাজির তাঁর বাড়িতে। টেবিলে গয়নার বটুয়া। ১৪-১৫ বছরের রাজামানির সমস্ত গহনা ফেরত দিতে এসেছেন নেতাজি। টেবিলের উল্টোদিকে বাবা। মুখে হাসি। রাজামানি জানিয়ে দিলেন তাঁর গয়না তিনি দেয়েছেন দেশের কাজে। ফেরত নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। নেতাজি অনড়। অনড় সে কন্যাও। শর্ত একটাই। আইএনএ-তে ভর্তি করলে গয়না ফেরত নিতে পারে সে। বাবাও মেয়ের সঙ্গে সহমত। নেতাজি সেদিন বলেছিলেন, লক্ষ্মী তো আসবে যাবে। কিন্তু তুমি হলে সরস্বতী। সেই থেকেই রাজামানি পরিচিত হলেন সরস্বতী রাজামানি নামে।
আইএনএ তে প্রাথমিক ভাবে নার্সের কাজের ট্রেইনিং দেওয়া হয় রাজামানিকে। সেখানে এক আহত সেনার আচরণে সন্দেহ হওয়ায় তাঁর পিছু নেয় রাজামানি। কান পেতে শোনে তাঁদের কথা বার্তা। সেই বার্তা পৌছে যায় নেতাজির কাছে। ধরা পড়ে বিশ্বাসঘাতক। নার্স রাজামানিকে এবার তুলে দেওয়া হয় আইএনএ-র ঝাঁসি বাহিনীর প্রধান লক্ষ্মী সায়গলের হাতে। সেখানেই চলে কঠোর সেনা প্রশিক্ষণ। সেখানেও সসম্মানে পাশ। প্রশিক্ষণ শিবিরেই তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় সমবয়সী দুর্গার সঙ্গে। সেই থেকে তাঁরা বন্ধু হয়ে যায়।
এরপর পুরোদস্তুর গুপ্তচর। রেঙ্গুনের অদূরে ব্রিটিশ সেনা ছাউনিতে ছেলের ছদ্মবেশে তাঁরা কাজে যোগ দেয়। মূলত হাউস কিপিং-এর কাজ। বছর খানেক সময়ে অনেক খবর পৌছে যায় আইএনএ শিবিরে। কিন্তু একদিন ধরা পড়ে যায় দুর্গা। গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। নেতাজির নির্দেশ ছিল যে ধরা পড়বে সে শত অত্যাচারেও মুখ খুলবে না। আর বাকিরা এলাকা থেকে স্রেফ ভ্যানিস হয়ে যাবে। আবার উল্টো পথে হাঁটল রাজামানি। বন্ধুকে উদ্ধার না করে ফিরবে না। ঐ সেনা ছাউনিতে আবার ফিরে আসে। এবার উচ্ছল মেয়ের পোষাকে। যে সেখানে নাচ গান করবে। সে সময়ে পানীয়তে নেশার বস্তু মিশিয়ে বেহুশ করে অফিসারদের। পরে গারদ খুলে উদ্ধার করে বন্ধুকে। পালানোর সময় পাহারাদারদের নজরে পড়ে যায় তাঁরা। গুলি ছোঁড়ে পাহারাদার। গুলি লাগে রাজামানির ডান পায়ে। সেই অবস্থাতে পালিয়ে একটা জঙ্গলের উচু গাছে আশ্রয় নেয় তাঁরা।
তিন দিন ঐ ভাবেই কাটে। ব্রিটিশ সার্চ পার্টি সরে গেলে গাছ থেকে নেমে রাস্তার দিকে এগোতে থাকে। বেলা ফুরায়। শেষবেলায় একটা গাড়ি জোটে। প্রায় আট ঘন্টার জার্নি শেষে তাঁরা পৌছায় আইএনএ ক্যাম্পে। তখন শরীরে প্রাণটুকুই সম্বল।
হাসপাতালে থাকাকালীন চিঠি পাঠান নেতাজি। তাতে লেখা ছিল ভারতের ইতিহাসে তুমিই সবচেয়ে কম বয়সী গুপ্তচর হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। রাজামানি কে লেফটেন্যান্ট পদে প্রমোশন দেওয়া হয়। হাসপাতালে এসে দেখা করেন ঝান্সি রানী বাহিনীর সর্বাধিনায়িকা ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সায়গল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ভেঙে যায় আইএনএ। সেনাবাহিনী বিভিন্ন পথ ধরে ফেরে দেশে। রাজামানিও ফিরে আসেন। সোজা চলে যান ত্রিচিতে পৈত্রিক বাড়িতে। সেখানেই অত্যন্ত দারিদ্রের মধ্যে তাঁর দিন কাটে। বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁর স্বাধীন ভারত।
স্বাধীন ভারতের সরকারের ২৫ বছরের বেশি সময় লাগে, আইএনএ সেনাবাহিনীকে স্বাধীনতার যোদ্ধা স্বীকৃতি দিতে। ততদিনে অনেকেই মরে গেছেন। হারিয়ে গেছেন ইতিহাসের গর্ভে। কিন্তু বেঁচে ছিলেন সরস্বতী রাজামানি। দারিদ্রের মধ্যে। কিন্তু নিজের কাজ ভোলেননি, ২০০৪ সুনামিতে দরজায় দরজায় ঘুরে সংগ্রহ করেছেন পুরানো পোষাক, কাপড়ের টুকরো। নিজে হাতে জামা বানিয়ে পাঠিয়েছেন সুনামি অনাথ আশ্রমে। ২০০৫-এ, অবহেলিত ও বিস্মৃত রাজামণিকে নিয়ে তামিলনাড়ুর সংবাদপত্রে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এক সাংবাদিকের খবরের জেরে গোটা তামিলনাড়ু, পরে দেশ, জানতে পারে ত্রিচির গ্রামে এক কামরা ঘরে বাস করেন ভারতের সর্বকনিষ্ঠ গুপ্তচর। মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেন। সরকারি সাহায্য আর বিনা ভাড়ায় বাসস্থান দেয় তামিলনড়ু সরকার। শুরু হয় লেখালিখি। তৈরি হয় ডক্যুমেন্টারি।
নিজের একানব্বইতম জন্মদিন পালনের ঠিক দুদিন পরেই প্রয়াত হন সরস্বতী রাজামানি। নেতাজির মতই অবহেলিত থেকে গেছেন সুভাষচন্দ্র বসুর শিষ্যা সরস্বতী রাজামানি। ইতিহাস ভুলেছে আমরা ভুলতে দেব না এই অজেয় বীরাঙ্গনার জীবন কাহিনী।
Tags:
saraswati
Netaji Subhash Chandra Bose
netaji subhas Chandra bose
netaji
netaji subhas
netaji subhas bose
netaji bose
netaji story in bengali
netaji news
freedom fighter netaji
INA chief Netaji
netaji INA
Rangoon
world war II netaji
netaji in rangoon
great kolkata escape
saraswati rajamani
saraswathy rajamani
the fiery saraswathi rajamani
spy saraswati rajamani
facts about lady spy saraswathi rajamani
unknown facts about lady spy saraswathi rajamani
saraswathi rajamani facts
about saraswathi rajamani
saraswathi rajamani netaji
sraswathi rajamani
lady spy saraswathi rajamani
saraswathi rajamani history
saraswathi rajamani biography
facts about saraswathi rajamani
rajamani
saraswati rajamani ina
youngest spy in india
first youngest spy in india
INA
indian national army
spy in india