২০ জুন কেন পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসেবে পালিত হয় ?
West Bengal Day: আজ ২০ জুন। পশ্চিমবঙ্গ দিবস। গত কয়েক বছরের মতো এবারও রাজ্য জুড়ে এই দিবসটিকে পালন করছে বিজেপি। ২০ জুন সরকারি ভাবে পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালনের দাবিতে এদিন বিধানসভা থেকে রেড রোড পর্যন্ত মিছিল করে বিজেপি পরিষদীয় দল। কিন্তু কেন আজকের দিনটিকে পশ্চিমবঙ্গ দিবসের ডাক দিয়েছে বিজেপি? চলুন সেদিকে নজর দেওয়া যাক।
ফেসবুকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী লিখেছেন, গোটা বাংলাকেই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিল মুসলিম লিগ। কিন্তু এর বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনি দাবি করেছিলেন, ভারত ভাগ হলে, বাংলাকেও ভাগ করে হিন্দুপ্রধান অঞ্চল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টি করতে হবে। উনি জনমত গঠন করতে পেরেছিলেন। তাই বঙ্গীয় আইনসভা বাংলা ভাগ করার প্রস্তাব পাশ করে। সে দিনটা ছিল ২০শে জুন ১৯৪৭।
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা থেকে বিজেপির শীর্ষ নেতারা যে দাবি করছেন, তার ইতিহাসের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। ১৯৪১ সালে যে জনগণনা হয়, তাতে দেখা যায়,অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম জনসংখ্যা ৫৩.৪ শতাংশ। হিন্দু ৪১.৭ শতাংশ। এছাড়া অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও বাস করতেন। এর আগেই তিরিশের দশকে ব্রিটিশ সরকার এনেছিল সাম্প্রদায়িক চুক্তি বা কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড। বাংলার আইনসভায় মুসলিম দের জন্য আসন বরাদ্দ হয়েছিল ১৩০টি। হিন্দু ও বাকিদের জন্য মাত্র ৯০টি। বঙ্গীয় আইনসভায় মুসলমানদের জন্য সংখ্যার অনুপাতে অতিরিক্ত প্রতিনিধিত্ব প্রদানই বাংলায় মৌলবাদের জন্ম দেয়।
সেসময়ই চুক্তির বিরোধিতায় সোচ্চার হয়েছিল বাংলার শিক্ষিত সমাজ। বিরোধিতা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ডাঃ নীলরতন সরকার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সহ আরও অনেকে। তাঁরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন যে বাংলায় সংখ্যায় মুসলমানরা বেশি হলেও শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, ব্যাবসা বাণিজ্য সবকিছুতেই হিন্দুরা অনেক এগিয়ে। সুতরাং বাংলার ভালমন্দের সিদ্ধান্ত কেবল জনসংখ্যার মানদণ্ডে হতে পারে না। বাংলার কংগ্রেস, বিশেষতঃ সুভাষচন্দ্র বসুও, এই চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন।
বিশিষ্ট চিন্তাবিদরা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেও ওই কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড মেনেই ১৯৩৭ সালে নির্বাচন হয়। বাংলায় শুরু হয় মুসলিম লিগের শাসন। এরপর দেশভাগের আগে পরপর কয়েকটি হিংসাত্মক ঘটনায় আসরে নামেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। বাঙালি হিন্দুর হোমল্যান্ডের জন্য সরব হন তিনি। পাশে পান ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার, ভাষাবিদ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, শিশির মিত্র, প্রমথরঞ্জন ঠাকুরদের। ১৯৪৬ সালে তিনি তৈরি করলেন বেঙ্গল পার্টিশন লিগ। এব্যাপারে পাশে পেলেন বাংলার কংগ্রেস নেতা ডাঃ বিধান রায়, অতুল্য ঘোষদেরও। বাংলা ভাগের পক্ষে সেবছর ৭৬টি বৈঠক হয়। ৫৯টির আহ্বায়ক কংগ্রেস। ১৯টি বৈঠক ডাকে হিন্দু মহাসভা। যৌথভাবে ডাকা হয় ৫টি।
১৯৪৭ সালের ২২ এপ্রিল দিল্লিতে এক সমাবেশে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ঘোষণা করেন, ভারত ভাগ হলে, বাংলাকেও ভাগ করতে হবে। ২৩ এপ্রিল বাংলার পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে তিনি ধর্মঘটও ডাকেন। সেসময় কমিউনিস্ট পার্টিও সেই ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়েছিল।
সেই সময় অমৃতবাজার পত্রিকা একটি সমীক্ষা করেছিল। তাতে দেখা যায় রাজ্যের ৯৮.৩% অমুসলমান তাদের জন্য এক পৃথক রাজ্য চান। বুদ্ধিজীবী থেকে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ পশ্চিমবঙ্গের দাবিতে আন্দোলন করতে থাকেন।
এই পরিস্থিতিতে ভারত ভাগে সিলমোহর দিতে দিল্লি আসেন লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন। তিনি যাতে সুরাবর্দীদের চাপের কাছে নতিস্বীকার না করেন, তার জন্য সোচ্চার হন শ্যামাপ্রসাদরা। বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে তখন মুসলিম সংখ্যাধিক্য। যৌথ অধিবেশনে ১২০-৯০ ভোটে ঠিক হয়, পুরো বাংলাই পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। তখন হিন্দু সংখ্যাধিক্য ওয়েস্টার্ন বেঙ্গল আলাদা ভাবে ভোটাভুটি করে। সেখানে দেখা যায়, ৫৮ জন চাইছেন বাংলা ভাগ হোক। ২১ জন এর বিপরীতে মত দেন। সম্ভবত এই একটি ক্ষেত্রেই জ্যোতি বসু, শ্যামাপ্রসাদ ও বিধান রায়রা একসঙ্গে ভোট দিয়েছিলেন। আর তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল ব্রিটিশ। চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছিল মুসলিম লিগের। আর এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এই ইতিহাস সামনে আনার জন্যই ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালনের ডাক দিয়েছে বিজেপি। কারণ সেদিন বাংলা ভাগ না আটকাতে পারলে আজ পশ্চিমবঙ্গ বাসীর ভাগ্য অন্যরকম হতে পারত।