মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: ওয়াকফ বোর্ড আইনে সংশোধন আনছে কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রের দাবি, কোনও ধর্মীয় সংগঠনের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা এই সংশোধনীর উদ্দেশ্য নয়। নতুন সংশোধনীতে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, ওয়াকফ সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে ডিস্ট্রিক্ট কালেকটরের অফিসে রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে, যাতে সম্পত্তির সঠিক মূল্যায়ন হয়। এতদিন পর্যন্ত কোনও নথি না থাকলেও, মৌখিকভাবে ওয়াকফ সম্পত্তি চিহ্নিত করা যেত। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ওয়াকফনামা অর্থা নথি না থাকলে সেই জমি বিতর্কিত বলেই ধরে নেওয়া হবে।
ওয়াকফ সম্পত্তি
সেই স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তিকেই ওয়াকফ সম্পত্তি বলা হয়, যা দলিলের মাধ্যমে আল্লার নামে করে দেওয়া হয়। সেই সম্পত্তি চ্যারিটির বা সেবার কাজে ব্যবহার করা হয়। নথিপত্রের যুগ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকে এই পদ্ধতি প্রচলিত আছে। সাধারণত কোনও জনসেবার কাজে ব্যবহৃত হয় এই জমি। অথবা কেউ উত্তরসূরী হিসেবে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। এই সম্পত্তি কখনও হস্তান্তর করা যায় না। সাধারণত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কবর, মসজিদের জন্য, গরিব মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য জমি ব্যবহার করা হয়।
ওয়াকফ বোর্ড
ওয়াকফ সম্পত্তি যাদের দায়িত্বে থাকে, আইনি ভাষায় তারাই ওয়াকফ বোর্ড। ১৯৬৪ সালে তৈরি হয় সেন্ট্রাল ওয়াকফ কাউন্সিল। দেশজুড়ে ওয়াকফ বোর্ডগুলি এই কাউন্সিলের নজরদারিতে চলে। সম্পত্তি নিয়ে ওয়াকফ বোর্ড ছাড়াও রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গেও সম্পত্তির বিষয়ে কথা বলে এই কাউন্সিল। প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিতে পারে। ওয়াকফ বোর্ড কেমন কাজ করছে, তাদের ব্যাপারে অডিট রিপোর্টও তৈরি করতে পারে এই কাউন্সিল। ১৯৯৫ সালে একটি আইন তৈরি হয়, যা সংশোধন হয় ২০১৩ সালে। সেই আইনে ওয়াকফ বোর্ডকেই ক্ষমতা দেওয়া হয়, যাতে তারাই ওয়াকফ সম্পত্তি চিহ্নিত করতে পারে।
আরও পড়ুন: গরীব ও মুসলিম মহিলাদের ক্ষমতায়ণের জন্যই ওয়াকফ সংশোধনী, দাবি কেন্দ্রের
ওয়াকফ আইনের অপব্যবহার
ভারতে ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনার জন্য প্রণীত ওয়াকফ আইন নিয়ে বেশ কিছু বিতর্ক এবং অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। ওয়াকফ আইন অপব্যবহার করে জমি জবরদখলের অভিযোগ উঠেছে এমন ১৫টি ঘটনা উল্লেখ করা হল—
তামিলনাড়ু: তিরুচিরাপল্লিতে পুরো একটি গ্রাম এবং একটি ১৫০০ বছরের পুরনো হিন্দু মন্দিরের মালিকানা দাবি করে ওয়াকফ বোর্ড, যা স্থানীয় গ্রামবাসীদের হতবাক করে দেয়।
হরিয়ানা (জথলানা গ্রাম, যমুনানগর জেলা): কোনও মুসলিম বসতি বা মসজিদের ইতিহাস না থাকলেও একটি গুরুদ্বারের জমি ওয়াকফ বোর্ডের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সুরাট, গুজরাট (২০২১): মুঘল সম্রাট শাহজাহান তাঁর কন্যাকে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসাবে দান করেছিলেন বলে দাবি করে সুরাট পুরসভা সদর দফতরকে ওয়াকফ সম্পত্তি ঘোষণা করা হয়, যদিও এটি প্রায় ৪০০ বছর আগের ঘটনা।
তাজ মহল (২০১৮): সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড দাবি করে যে তাজ মহলকে তাদের সম্পত্তি হিসাবে তালিকাভুক্ত করা উচিত, যদিও তাদের কোনও স্বাক্ষরিত মালিকানার দলিল ছিল না।
উত্তর প্রদেশ (২০২২): সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড দাবি করে যে যেখানে জ্ঞানব্যাপী মসজিদ আজ দাঁড়িয়ে আছে সেই জমি ওয়াকফ সম্পত্তি, যা মন্দির পক্ষ থেকে আদালতে প্রত্যাখ্যান করা হয়।
লখনউ, উত্তর প্রদেশ: একটি শিবালয় (শিব মন্দির) শিয়া সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডের সাথে যোগসাজশে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসাবে নিবন্ধিত করা হয়, যদিও মন্দিরটি ১৮৬২ সাল থেকে রেকর্ডে ছিল এবং ওয়াকফ বোর্ডের প্রতিষ্ঠা ১৯০৮ সালে হয়েছিল।
দেবভূমি দ্বারকা, গুজরাট (২০২১-২০২২): ওয়াকফ বোর্ড বেট দ্বারকার দুটি দ্বীপের মালিকানা দাবি করে, যা গুজরাট উচ্চ আদালত প্রত্যাখ্যান করেছে।
ঔরঙ্গাবাদ, মহারাষ্ট্র (২০১৪): ওয়াকফ বোর্ড ঔরঙ্গাবাদ পুরসভাকে একটি বিতর্কিত জমি দাবি করে নোটিশ পাঠায়, যেখানে রাস্তা প্রশস্তকরণের জন্য জমি অধিগ্রহণের চেষ্টা চলছে।
হায়দরাবাদ, তেলঙ্গানা (২০১৩): তেলঙ্গানা ওয়াকফ বোর্ড হায়দরাবাদ পুর কর্পোরেশনের একটি রাস্তা প্রশস্তকরণের প্রচেষ্টাকে বিরোধিতা করে, দাবি করে যে জমিটি ওয়াকফ সম্পত্তি।
পুণে এবং পারভানি, মহারাষ্ট্র (২০১৮): একটি পাইলট প্রকল্পে শুধু দুইটি জেলাতেই ১৭০০টিরও বেশি নতুন ওয়াকফ সম্পত্তি শনাক্ত করা হয়।
পাঞ্জাব: ভারতে মোট ১৬,৯৩৭টি ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তির মধ্যে ৫,৬১০টি পাঞ্জাবে রয়েছে, যেখানে সর্বাধিক অনধিকার প্রবেশ ঘটেছে।
মহারাষ্ট্র (২০১৭): রাজ্য সরকার একটি মুসলিম সংস্থার সাবেক প্রধানকে বরখাস্ত করে, যার দায়িত্ব ছিল জমি দান করা। সন্দেহ হয় যে, ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে বরাদ্দকৃত ওয়াকফ জমি অবৈধভাবে বিক্রি করা হয়েছে।
দিল্লি (২০২৪): দিল্লি উচ্চ আদালত বিতর্কিত ওয়াকফ সম্পত্তিতে অনুমোদনহীন নির্মাণের কথা উল্লেখ করে, যেখানে দিল্লি ওয়াকফ বোর্ড ১২৩টি সম্পত্তির দাবি করে, যদিও কেন্দ্র তা বাতিল করে দেয়।
হালদ্বানি, উত্তরাখণ্ড (২০২৪): ওয়াকফ বোর্ড সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন করে যে জমিটি রেলওয়ের বলে উত্তরাখণ্ড উচ্চ আদালত ঘোষণা করেছে, সেই জমির কিছু অংশ তাদের।
পুঞ্চ, জম্মু ও কাশ্মীর (২০১৪): রাজ্য সরকার জানায় যে, ৩৬০ ক্যানালেরও বেশি ওয়াকফ জমি বাণিজ্যিক মূল্যসহ সেনাবাহিনীর দখলে রয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ২১ ক্যানালের জন্য ভাড়া দেওয়া হচ্ছে।
এই ঘটনাগুলি ওয়াকফ আইন এবং এর প্রয়োগ নিয়ে বিতর্ক বাড়িয়ে তুলেছে। নয়া সংশোধনী এই বিতর্কিত বিষয়গুলির মীমাংসা করবে , বলে অনুমান।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।
+ There are no comments
Add yours